আত্ম-বিলাপ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
https://www.facebook.com/abdullahmandal325.mobi/
আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু,হায়,
তাই ভাবী মনে?
জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে যায়,
ফিরাব কেমনে?
দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন ,—
তবু এ আশার নেশা ছুটিল না? এ কি দায়!
রে প্রমত্ত মন মম! কবে পোহাইবে রাতি?
জাগিবি রে কবে?
জীবন-উদ্যানে তোর যৌবন-কুসুম-ভাতি
কত দিন রবে?
নীর বিন্ধু, দূর্বাদলে,নিত্য কিরে ঝলঝলে?
কে না জানে অম্বুবিম্ব অম্বুমুখে সদ্যঃপাতি?
নিশার স্বপন-সুখে সুখী যে কী সুখ তার?
জাগে সে কাঁদিতে!
ক্ষণপ্রভা প্রভা -দানে বাড়ায় মাত্ত আঁধার
পথিকে ধাঁদিতে!
মরীচিকা মরুদেশে,নাশে প্রাণ তৃষাক্লেশে—
এ তিনের ছল সম ছল রে এ কু-আশার।
প্রেমের নিগড় গড়ি পরিলি চরণে সাদে
কী ফল লভিলি?
জ্বলন্ত-পাবক-শিখা-লোভে তুই কাল ফাঁদে
উড়িয়া পড়িলি
পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়,ধাইলি,অবোধ,হায়
না দেখলি না শুনিলি,এবে রে পরাণ কাঁদে
বাকি কি রাখিলি তুই বৃথা অর্থ-অন্বেষণে,
সে সাধ সাধিতে?
ক্ষত মাত্ত হাত তোর মৃণাল-কণ্টকগণে
কমল তুলিতে
নারিলি হরিতে মণি, দঃশিল কেবল ফণী
এ বিষম বিষজ্বালা ভুলিবি, মন,কেমনে!
যশোলাভ লোভে আয়ু কত যে ব্যয়িলি হায়,
কব তা কাহারে?
সুগন্ধ কুসুম-গন্ধে অন্ধ কীট যথা ধায়,
কাটিতে তাহারে?
মাৎসর্য-বিষদশন, কামড়ে রে অনুক্ষণ!
এই কি লভিলি লাভ,অনাহারে,অনিদ্রায়?
মুকুতা-ফলের লোভে,ডুবে রে অতল জলে
যতনে ধীবর,
শতমুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধু জলতলে
ফেলিস,পামড়!
ফিরি দিবি হারাধন,কে তোরে,অবোধ মন,
হায় রে,ভুলিবি কত আশার কুহক-ছলে!
কবি পরিচিতি
আধুনিক বাংলা কবিতার অগ্রদূত মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫এ জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজনারায়ণ দত্ত, জননী জাহ্নবী দেবী।
মায়ের তত্ত্বাবধানে গ্রামেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। মধুসূদন ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার হিন্দু কলেজের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখানে ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর সাহিত্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে তিনি পিতৃপ্রদত্ত নামের শুরুতে ‘মাইকেল’ নাম যোগ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে তাঁকে হিন্দু কলেজ পরিত্যাগ করে শিবপুরের বিশপ্স কলেজে ভর্তি হতে হয়। এখানেই তিনি গ্রিক, লাতিন ও হিব্রু ভাষা শিক্ষার সুযোগ পান। মধুসূদন বুৎপন্ন ছিলেন বহু ভাষার। ইংরেজি ও সংস্কৃতিসহ ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয় ভাষাতেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
হিন্দু কলেজে ছাত্রাবস্থায় তাঁর সাহিত্যচর্চার মাধ্যম ছিল ইংরেজি ভাষা। কিন্তু বিদেশি ভাষার মোহ থেকে মুক্ত হয়ে তিনি মাতৃভাষার কাছে ফিরে আসেন। মাতৃভাষা বাংলা রচিত অমর কাব্যের তিনি স্রষ্টা। রোমান্টিক ও ধ্রুপদী সাহিত্যের আশ্চর্য মিলন ঘটেছে তাঁর সাহিত্যে। দেশপ্রেম, স্বাধীনতা চেতনার এবং নারী-জাগরণ মধুসূদনের সাহিত্যের প্রধান সুর। মধুসূদন-পূর্ব হাজার বছরের বাংলা কবিতার ছন্দ ছিল পয়ার। একটি চরণের শেষে আর একটি চরণের মিল ছিল ওই ছন্দের অনড় প্রথা। মধুসূদন বাংলা কবিতার এ প্রথাকে ভেঙে দিলেন। তিনি প্রথম চরণের সঙ্গে দ্বিতীয় চরণের মিল রক্ষা করেননি বলেই তাঁর প্রবর্তিত ছন্দকে বলা হয় ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’। তবে এটি বাংলা অক্ষরবৃত্ত ছন্দেরই নবরূপায়ণ। তাঁর শ্রেষ্ঠতম কীর্তি ‘মেঘনাদ-বধ কাব্য’ এ ছন্দের সফল প্রয়োগ ঘটে। এ ছন্দে আরও কিছু নতুন বিষয় তিনি যোগ করেছিলেন বলে একে বলা হয় ‘১৪ মাত্রার অমিল প্রবহমান যতি স্বাধীন অক্ষরবৃত্ত ছন্দ’। বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেটেরও প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলা নাটকের উদ্ভবযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার তিনি। আধুনিক নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’ ও ‘কৃষ্ণকুমারী’ ও প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ ও ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো হলো : তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলি।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯এ জুন কলকাতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত মৃত্যুবরণ করেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
https://www.facebook.com/abdullahmandal325.mobi/
আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু,হায়,
তাই ভাবী মনে?
জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে যায়,
ফিরাব কেমনে?
দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন ,—
তবু এ আশার নেশা ছুটিল না? এ কি দায়!
রে প্রমত্ত মন মম! কবে পোহাইবে রাতি?
জাগিবি রে কবে?
জীবন-উদ্যানে তোর যৌবন-কুসুম-ভাতি
কত দিন রবে?
নীর বিন্ধু, দূর্বাদলে,নিত্য কিরে ঝলঝলে?
কে না জানে অম্বুবিম্ব অম্বুমুখে সদ্যঃপাতি?
নিশার স্বপন-সুখে সুখী যে কী সুখ তার?
জাগে সে কাঁদিতে!
ক্ষণপ্রভা প্রভা -দানে বাড়ায় মাত্ত আঁধার
পথিকে ধাঁদিতে!
মরীচিকা মরুদেশে,নাশে প্রাণ তৃষাক্লেশে—
এ তিনের ছল সম ছল রে এ কু-আশার।
প্রেমের নিগড় গড়ি পরিলি চরণে সাদে
কী ফল লভিলি?
জ্বলন্ত-পাবক-শিখা-লোভে তুই কাল ফাঁদে
উড়িয়া পড়িলি
পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়,ধাইলি,অবোধ,হায়
না দেখলি না শুনিলি,এবে রে পরাণ কাঁদে
বাকি কি রাখিলি তুই বৃথা অর্থ-অন্বেষণে,
সে সাধ সাধিতে?
ক্ষত মাত্ত হাত তোর মৃণাল-কণ্টকগণে
কমল তুলিতে
নারিলি হরিতে মণি, দঃশিল কেবল ফণী
এ বিষম বিষজ্বালা ভুলিবি, মন,কেমনে!
যশোলাভ লোভে আয়ু কত যে ব্যয়িলি হায়,
কব তা কাহারে?
সুগন্ধ কুসুম-গন্ধে অন্ধ কীট যথা ধায়,
কাটিতে তাহারে?
মাৎসর্য-বিষদশন, কামড়ে রে অনুক্ষণ!
এই কি লভিলি লাভ,অনাহারে,অনিদ্রায়?
মুকুতা-ফলের লোভে,ডুবে রে অতল জলে
যতনে ধীবর,
শতমুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধু জলতলে
ফেলিস,পামড়!
ফিরি দিবি হারাধন,কে তোরে,অবোধ মন,
হায় রে,ভুলিবি কত আশার কুহক-ছলে!
কবি পরিচিতি
আধুনিক বাংলা কবিতার অগ্রদূত মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫এ জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজনারায়ণ দত্ত, জননী জাহ্নবী দেবী।
মায়ের তত্ত্বাবধানে গ্রামেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। মধুসূদন ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার হিন্দু কলেজের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখানে ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর সাহিত্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে তিনি পিতৃপ্রদত্ত নামের শুরুতে ‘মাইকেল’ নাম যোগ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে তাঁকে হিন্দু কলেজ পরিত্যাগ করে শিবপুরের বিশপ্স কলেজে ভর্তি হতে হয়। এখানেই তিনি গ্রিক, লাতিন ও হিব্রু ভাষা শিক্ষার সুযোগ পান। মধুসূদন বুৎপন্ন ছিলেন বহু ভাষার। ইংরেজি ও সংস্কৃতিসহ ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয় ভাষাতেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
হিন্দু কলেজে ছাত্রাবস্থায় তাঁর সাহিত্যচর্চার মাধ্যম ছিল ইংরেজি ভাষা। কিন্তু বিদেশি ভাষার মোহ থেকে মুক্ত হয়ে তিনি মাতৃভাষার কাছে ফিরে আসেন। মাতৃভাষা বাংলা রচিত অমর কাব্যের তিনি স্রষ্টা। রোমান্টিক ও ধ্রুপদী সাহিত্যের আশ্চর্য মিলন ঘটেছে তাঁর সাহিত্যে। দেশপ্রেম, স্বাধীনতা চেতনার এবং নারী-জাগরণ মধুসূদনের সাহিত্যের প্রধান সুর। মধুসূদন-পূর্ব হাজার বছরের বাংলা কবিতার ছন্দ ছিল পয়ার। একটি চরণের শেষে আর একটি চরণের মিল ছিল ওই ছন্দের অনড় প্রথা। মধুসূদন বাংলা কবিতার এ প্রথাকে ভেঙে দিলেন। তিনি প্রথম চরণের সঙ্গে দ্বিতীয় চরণের মিল রক্ষা করেননি বলেই তাঁর প্রবর্তিত ছন্দকে বলা হয় ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’। তবে এটি বাংলা অক্ষরবৃত্ত ছন্দেরই নবরূপায়ণ। তাঁর শ্রেষ্ঠতম কীর্তি ‘মেঘনাদ-বধ কাব্য’ এ ছন্দের সফল প্রয়োগ ঘটে। এ ছন্দে আরও কিছু নতুন বিষয় তিনি যোগ করেছিলেন বলে একে বলা হয় ‘১৪ মাত্রার অমিল প্রবহমান যতি স্বাধীন অক্ষরবৃত্ত ছন্দ’। বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেটেরও প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলা নাটকের উদ্ভবযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার তিনি। আধুনিক নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’ ও ‘কৃষ্ণকুমারী’ ও প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ ও ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো হলো : তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলি।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯এ জুন কলকাতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত মৃত্যুবরণ করেন।









No comments:
Post a Comment