বাংলার জাগরণ
কাজী আবদুল ওদুদ
কাজী আবদুল ওদুদ
https://www.facebook.com/abdullahmandal325.mobi/
________________________________
কাজী আবদুল ওদুদ
ওদুদ, কাজী আবদুল (১৮৯৪- ১৯৭০) শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ। জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। পিতা কাজী সৈয়দ হোসেন। তিনি পেশায় ছিলেন রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার। মাতা খোদেজা খাতুন।
কাজী আবদুল ওদুদ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৩ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ১৯১৫ সালে আই-এ এবং ১৯১৭ সালে বি এ পাস করেন। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পলিটিক্যাল ইকোনমিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এমএ পাস করার অব্যবহিত পরেই তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কিছুদিন একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর ১৯২০ সালে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বাংলার প্রভাষকের পদে যোগদান করেন এবং ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এ কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪০ সালে বাংলা সরকার প্রাদেশিক টেক্সটবুক কমিটির সেক্রেটারি ও রীডারের পদ সৃষ্টি করলে তিনি উক্ত পদে নিয়োগ লাভ করে কলকাতায় শিক্ষাদফতরে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উক্ত পদের সঙ্গে রেজিস্টার অব পাবলিকেশন্স পদটি যুক্ত করে। কাজী আবদুল ওদুদ এ গুরুত্বপূর্ণ পদে এগারো বছর কর্মরত থাকার পর ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে অবসর গ্রহণ করেন।
কলেজে অধ্যয়নকালেই কাজী আবদুল ওদুদ সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ছাত্র অবস্থায়ই তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ মীর পরিবার (১৯১৮) এবং উপন্যাস নদীবক্ষে (১৯১৯) প্রকাশিত হয়। এমএ পাস করার পর তিনি কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আবাসিক ভবনে কিছুদিন অবস্থান করেন। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এখানেই। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে সাহিত্যিকদের আড্ডা বসত। যুদ্ধফেরত নজরুলের উপস্থিতিতে সে আড্ডা আরও বেগবান হয়ে ওঠে। কাজী আবদুল ওদুদের লেখক জীবনের ভিত্তি গড়ে ওঠে এ কবি-সাহিত্যিকদের সাহচর্যেই। তবে তাঁর চিন্তা ও চেতনাকে পরিণতি দান করে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজ (১৯২৬)। সাহিত্য-সমাজের মুখপত্র শিখার প্রতিটি সংখ্যার পরিকল্পনা ও প্রকাশনায় আবুল হুসেনের সঙ্গে তাঁর সক্রিয় প্রয়াসপ্রযত্ন ছিল। তবে কাজী আবদুল ওদুদের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে সংকল্প (১৩৬১) ও তরুণপত্র (১৩৭২) নামে দুটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন প্রথমটির সম্পাদক এবং দ্বিতীয়টির সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারায় কাজী আবদুল ওদুদের প্রধান পরিচয় চিন্তাশীল লেখক হিসেবে। তবে তাঁর লেখালেখি শুরু হয় কথাসাহিত্যের মাধ্যমে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ মীর পরিবার পাঁচটি গল্পের সংকলন। এরপর তিনি তিনটি গল্প রচনা করেন যা পরবর্তী সময়ে তরুণ (১৯৪৮) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। নদীবক্ষে ও আজাদ (১৯৪৮) তাঁর দু’টি উপন্যাস। নাটকও রচনা করেন দু’টি, পথ ও বিপথ (১৯৩৯) এবং মানব-বন্ধু (১৯৪১)। মানব-বন্ধু পরবর্তীকালে তরুণ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়।
কাজী আবদুল ওদুদের কয়েকটি গ্রন্থ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। তাঁর মননশীলতা এবং বৈদগ্ধের প্রকাশ লক্ষ করা যায় শাশ্বত বঙ্গ (১৯৫১) বাংলার জাগরণ (১৩৬৩), কবিগুরু গ্যেটে (১ম ও ২য় খন্ড ১৩৫৩), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ (১ম খন্ড ১৩৬৯, ২য় খন্ড ১৩৭৬), হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম (১৩৭৩) গ্রন্থে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকায় যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সংঘটিত হয়, যাঁরা মুসলিম সাহিত্য-সমাজ নামে পরিচিত ছিলেন, কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন এ আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বিচার-বুদ্ধিকে সংস্কার মুক্ত ও গতিশীল করার প্রচেষ্টায় যে সকল চিন্তা ও বক্তব্য নিয়ে কাজী আবদুল ওদুদ ও তাঁর সহকর্মীদের অগ্রসর হতে দেখা যায়, শাশ্বত বঙ্গ তার একটি মূল্যবান দলিল। তাঁর উদারনৈতিক মনোভাব এবং নিজের সমাজ ও সম্প্রদায়ের দৈন্যের জন্য আক্ষেপ এ গ্রন্থের আর একটি দিক। পরিবেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গভীর ভালোবাসার, প্রেম তাঁর বক্তব্যের এক প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। শাশ্বত বঙ্গ তাই সাজাত্যবোধে উজ্জ্বল। তাঁর শাশ্বত বঙ্গ অনৈতিহাসিক সোনার বাংলা এবং আদর্শায়িত রূপকথার কাহিনী নয়। প্রকৃতপক্ষে এ বঙ্গে মানুষের জীবন দীনহীন ও নানা সংস্কারে পীড়িত। অনগ্রসরতার গ্লানি তাঁর নিত্য সঙ্গী। কিন্তু সে দীনতাকে চিরস্থায়ী বলে মনে করেন না তিনি। তাঁর বঙ্গ সৃষ্টিশীল ও সম্ভাবনাময়।
এ বঙ্গদেশে, কাজী আবদুল ওদুদ মনে করতেন, উনিশ শতকে একটি রেনেসাঁস সংঘটিত হয়, যার একটি বড় বক্তব্য ছিল, স্বদেশপ্রেমে দোষ নেই যতক্ষণ স্বাদেশিকতা না হয় বিশ্ববিমুখ। তাঁর বাংলার জাগরণ বিষয়ক আলোচনার এক প্রধান প্রেরণা ছিল এটা। এ প্রেরণায় তিনি লিখেছেন বাংলার জাগরণ গ্রন্থ। তাঁর মতে রামমোহন থেকে ঢাকার ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন পর্যন্ত যে প্রয়াস, সেটা এ প্রেরণার ফল। অন্যদিকে তাঁর কবিগুরু গ্যেটে গ্রন্থের বক্তব্যও এ প্রেরণাজাত। গ্যেটের স্বচ্ছ ও সবল মুক্তবুদ্ধি এদেশের মানুষকেও সাহায্য করবে জীবনের দায়িত্ব, প্রতিভা, ধর্ম, স্বদেশপ্রেম, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের অর্থ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রকে বাড়িয়ে তুলতে। তিনি অনুপ্রাণিত হন গ্যেটের সত্যাশ্রয়ী ব্যাপক জীবনবোধ ও বিশ্ববোধের মন্ত্রে ও দৃষ্টান্তে।
কাজী আবদুল ওদুদ স্বদেশচেতনার সঙ্গে বিশ্বচেতনার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত লক্ষ করেন রবীন্দ্রনাথের জীবনে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও কর্মক্ষেত্রের নিবিষ্ট পাঠক ও আলোচক ছিলেন তিনি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর গভীর সাহিত্যবোধ ও ব্যাপক মননশীলতার পরিচয়বাহী গ্রন্থ। হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম তাঁর পরিণত বয়সের রচনা। তিনি এ গ্রন্থে হজরত মোহাম্মদকে রক্ত-মাংসের মানুষ এবং ঐতিহাসিক এক সঙ্কটকালের মহৎ পুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করেন। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সমগ্র মানবজাতির প্রতি যাঁর ছিল অপরিসীম দরদ ও দায়িত্ব। হজরত মোহাম্মদ মানবজাতির মুক্তির লক্ষ্যে সাম্যদৃষ্টি ও জ্ঞানানুরাগের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কাজী আবদুল ওদুদ এ বক্তব্যটি তাঁর উক্ত গ্রন্থে বিশেষভাবে তুলে ধরেন।
১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় কাজী আবদুল ওদুদের ব্যবহারিক শব্দকোষ। আধুনিক বাংলা ভাষার একটি জনপ্রিয় অভিধান সংকলনে তাঁর ভাষা সচেতন মনের পরিচয় মেলে এখানে। অভিধানটির বিশেষত্ব হলো, এতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আরবি, ফার্সি ও তুর্কি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণের প্রয়াস আছে এবং বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত শব্দসমূহ অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে।
কাজী আবদুল ওদুদের অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, প্রবন্ধ ও সাহিত্যসমালোচনা: নবপর্যায় (১ম খন্ড ১৩৩৩, ২য় খন্ড ১৩৩৬), সমাজ ও সাহিত্য (১৩৪১), হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ (১৩৪২), Fundamentals of Islam (১৩৫৭), State and Literature (১৩৬৪), Tagore’s Role in the Reconstruction of Indian Thought(১৩৬৮), আজকার কথা (১৩৪৮), স্বাধীনতা দিনের উপহার (১৩৫৮), রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৩৩৪), নজরুল-প্রতিভা (১৩৫৬), শরৎচন্দ্র ও তারপর (১৩৬৮); জীবনীগ্রন্থ: অনুবাদ গ্রন্থ: Creative Bengal (১৩৫৭), পবিত্র কোরআন (১ম ভাগ ১৩৭৩, ২য় ভাগ ১৩৭৪)। এ ছাড়া রয়েছে কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলী (১ম খন্ড ১৯৮৮, ২য় খন্ড ১৯৯০, ৩য় খন্ড ১৯৯২, ৪র্থ খন্ড ১৯৯৩, ৫ম খন্ড ১৯৯৪ ও ৬ষ্ঠ খন্ড ১৯৯৫) এবং কাজী আবদুল ওদুদের পত্রাবলী (১৯৯৯)।
কাজী আবদুল ওদুদের গদ্যের প্রধান ভিত্তি যুক্তি, পরিমিতিবোধ এবং আত্মপ্রত্যয়। বাংলা গদ্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই ত্রিবিধ গুণসম্পন্ন বাংলা রচনার উদাহরণ খুব বেশি নেই। তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁকে বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট গদ্যশিল্পীরূপে চিহ্নিত করা যায়। পশ্চাদপদ বাঙালি মুসলমান সমাজে মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে কাজী আবদুল ওদুদের অবদান বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। ১৯৭০ সালের ১৯ মে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
বাংলার জাগরন:
আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির ধারণা এই যে, বাংলার জাগরণ পাশ্চাত্য প্রভাবের ফল। কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু পুরোপুরি সত্যও যে নয় সে দিকটা ভেবে দেখবার আছে। যাঁরা এই জাগরণের নেতা তাঁরা কি উদ্দেশ্য আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ও এই জাগরণের ফলে দেশের যা লাভ হয়েছে তার স্বরূপ কি, এই সমস্ত চিন্তা করলে হয়ত আমাদের কথা ভিত্তিশূন্য মনে হবে না। রাজা রামমোহন রায়ের ব্রহ্মজ্ঞান প্রচার থেকে আরম্ভ করে বাজনা ও গো-হত্যা নিয়ে হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গা পর্যন্ত আমাদের দেশের চিন্তা ও কর্মধারা, আর ডিইস্ট এনসাইক্লোপিডিস্ট থেকে আরম্ভ করে বোলশেভিজম পর্যন্ত পাশ্চাত্য চিন্তা ও কর্মধারা এই দুইয়ের উপর চোখ বুলিয়ে গেলেও বুঝতে পারা যায়- আমাদের দেশ তার নিজের কর্মফলের বোঝাই বহন করে চলেছে পাশ্চাত্যর সঙ্গে তার পার্থক্য যথেষ্ট লক্ষ্যযোগ্য। এই পার্থক্য এই সঙ্গে আমাদের জন্য আনন্দের ও বিষাদের। আনন্দের এই জন্য যে, এতে করে আমাদের একটা বিশিষ্ট সত্তার পরিচয় আমরা লাভ করি অসভ্য বা অর্ধসভ্য জাতির মতো আমরা শুধু ইউরোপের প্রতিধ্বনি মাত্র নই; আর বিষাদের এই জন্য যে আমাদের জাতীয় চিন্তা ও কর্ম-পরম্পরার ভেতর দিয়ে আমাদের যে ব্যক্তিত্ব সুপ্রকট হয়ে ওঠে সেটি অতীতের অশেষ অভিজ্ঞতা পুষ্ট অকুতোভয় আধুনিক মানুষের ব্যক্তিত্ব নয়, সেটি অনেকখানি অল্প পরিসর শাস্ত্রশাসিত মধ্যযুগীয় মানুষের ব্যক্তিত্ব।
২.
বাংলার নবজাগরণের প্রভাত-নক্ষত্র যে রাজা রামমোহন রায় সে সম্বন্ধে কোন মতভেদ নাই। কিন্তু তাকে জাতীয় জাগরণের প্রভাত নক্ষত্র না বলে প্রভাত সূর্য্য বলাই উচিত, কেননা, জাতীয় জীবনের কেবল মাত্র একটি নব চৈতন্যের সাড়াই তার ভেতরে অনুভূত হয় না, সেইদিনে এমন একটি বিরাট নব আদর্শ তিনি জাতির সামনে উপস্থাপিত করে গেছেন যে, এই শত বছরেও আমাদের দেশে আর দ্বিতীয় ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন নাই যার আদর্শ রামমোহনের আদর্শের সঙ্গে তুলিত হতে পারে। এমন কি, এই শত বছরে আমাদের দেশে অন্যান্য যে সমস্ত ভাবুক ও কর্মী জন্মেছেন তাঁদের প্রয়াসকে পাদপীঠরূপে ব্যবহার করে তার উপর রামমোহনের আদর্শের নবপ্রতিষ্ঠা করলে দেশের জন্য একটা সত্যিকার কল্যাণের কাজ হবে এই আমাদের বিশ্বাস। এই রামমোহন যে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, পাশ্চাত্য জীবনাদর্শ ইত্যাদির দিকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নাই। তবু এ কথা সত্য যে, এই পাশ্চাত্য কৃষ্টির সংস্রবে তিনি এসেছিলেন পূর্ণযৌবনে। তার আগে আরবী-ফার্সী ও সংস্কৃত অভিজ্ঞ রামমোহন পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে পিতা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে বাদানুবাদ করেছেন, গৃহত্যাগ করে তিব্বত, উত্তর ভারত ভ্রমণ করেছেন, আর সেই অবস্থায় নানক, কবীর প্রভৃতি ভক্তদের ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন- যাঁরা হিন্দু-চিন্তার উত্তরাধিকার স্বীকার করেও পৌত্তলিকতা, অবতারবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ৩.
রামমোহন জাতীয় জীবনে যে সমস্ত কর্মের প্রবর্তনার সঙ্কলন করেছিলেন তার মধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দু কলেজ অনতিবিলম্বে ফল প্রসব করতে আরম্ভ করে। হিন্দু কলেজের সঙ্গে ডিরোজিও’র নাম চিরদিনের জন্য একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। এই ডিরোজিও যে গুরুর শিষ্য ‘ফরাসী’ বিপ্লবের চিন্তার স্বাধীনতা বহ্নি তাঁর ভেতরে প্রজ্বলিত ছিল। ডিরোজিও’র সেই বহ্নি-দীক্ষা হয়েছিল। অল্প বয়সে যথেষ্ট বিদ্যা অর্জন করে কবি ও চিন্তাশীলরূপে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। বিশ বছর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজের চতুর্থ শিক্ষকরূপে নিয়োজিত হন, আর তিন বছর শিক্ষকতা করার পর সেখান থেকে বিতাড়িত হন। এরই ভেতর তাঁর শিষ্যদের চিত্তে যে আগুন তিনি জ্বালিয়ে দেন তাঁর কলেজ পরিত্যাগের পরও বহুদিন পর্যন্ত তাঁর তেজ মন্দিভূত হয় নাই। শুধু তাই নয়, নব্যবঙ্গের গুরুদের ভেতর এই ডিরোজিত্ত’র এক বিশিষ্ট স্থান আছে। এর শিষ্যরা অনেকেই চরিত্র, বিদ্যা, সত্যানুরাগ ইত্যাদির জন্য জাতীয় জীবনে গৌরবের আসন লাভ করেছিলেন, এরইসঙ্গে হিন্দু সমাজের আচার-বিচার, বিধি-নিষেধ ইত্যাদির লঙ্ঘন দ্বারা সুনাম বা কুনাম অর্জন করে সমস্ত সমাজের ভেতরে একটা নব মনোভাবের প্রবর্তনা করেন।
৪.
রামমোহনের শ্রেষ্ঠ দান কী তা নিয়ে আগেও বাংলাদেশে তর্ক-বির্তক হয়েছে, ভবিষ্যতের জন্যও যে সে তর্ক-বিতর্কের প্রয়োজনীয়তা চুকে গেছে তা নয়। তবে যে সমস্ত বাদ প্রতিবাদ হয়েছে তার মধ্যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অক্ষয় কুমার দত্তের বাদানুবাদই সুবিখ্যাত। দেবেন্দ্রনাথ ঈশ্বর-প্রেমিক পরুষ ছিলেন। হাফেজের যেসব লাইন তাঁর অতি প্রিয় ছিল তার একটি এই- হরগিজম মোহরে তু আজ লওহে দিল ও জাঁ না বরদ। তাঁর জীবনের সমস্ত সম্পদ বিপদের ভেতর দিয়ে তাঁকে এই প্রেমের পরিচয় তাঁর দেশবাসীরা পেয়েছেন। প্রথম জীবনেই যে পরীক্ষায় তাঁকে উত্তীর্ণ হতে হয়েছিল তা কঠোর-সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে সর্বস্ব দানে তিনি পিতৃঋণ হতে উদ্ধার পাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। সত্যের যাত্রাপথে ‘মহান মৃত্যু’র এমননিভাবে সম্মুখীন হওয়া সমস্ত বাঙালী জীবনে এক মহা ঘটনা যাকে বেষ্টন করে বাংলার ভাবস্রোতের নৃত্য চলতে পারে হয়ত চলেছে। কিন্তু গুহাপথের যাত্রী হয়েও দেবেন্দ্রনাথ গভীরভাবে জ্ঞানানুরাগী ও সৌন্দর্যানুরাগী ছিলেন। তবু সংসারনিষ্ঠা, জ্ঞানানুশীলন, সৌন্দর্যস্পৃহা, সমস্তের ভেতরে ঈশ্বরপ্রেমই ছিল তার অন্তরের অন্তরতম বস্তু। তাই তিনি যে রামমোহনকে মুখ্যত ব্রহ্মজ্ঞানের প্রচারকরূপে দেখবেন এটাই স্বাভাবিক।
৫.
আমরা বলেছি বাংলায় এ পর্যন্ত যে চিন্তা ও কর্মধারার বিকাশ হয়েছে তাতে মধ্যযুগীয় প্রভাব বেশি। দেবেন্দ্রনাথের কাব্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তিনি মানুষের চিত্তকে বহ্ম পাদপীঠ বলে সম্মান দিয়েছেন। শুধু প্রাচীন ঋষিদের যে কেবল সে অধিকার ছিল তা তিনি মানেন নাই। কিন্তু এই আবিষ্কৃত সত্যের পুরো ব্যবহারে তিনি যেন কেমন সঙ্কোচবোধ করেছেন। এই ‘আত্মপ্রত্যয়-সিদ্ধ জ্ঞানোজ্জ্বলিত বিশুদ্ধ হুদয়’ কথাটি তিনি পেয়েছিলেন উপনিষদ থেকে- নিজের জীবনের ভেতরে এ কথার সায় তিনি নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন। কিন্তু অন্তত প্রয়োজনতাড়িত মানুষকে এই অমৃতের সাধনা জীবনের সমস্ত কর্ম সমস্ত অবসর, সমস্ত প্রার্থনা, সমস্ত অপ্রার্থনার ভেতর দিয়ে করতে হবে শুধু বিধিবদ্ধ প্রার্থনার ভেতর দিয়েই নয়- এতটা অগ্রসর হতে তিনি যেন পশ্চাদপদ হয়েছেন। হয়ত বৃহত্তর মনীষা নিয়ে তিনি যদি অক্ষয় কুমারকে আত্মসাত করতে পারতেন তাহলে ব্রাহ্ম সমাজ তাঁর হাতে যে রূপ লাভ করত তা দেশের পক্ষে আরও কল্যাণদায়ক হতো।
৬.
সব ধর্মই কি সত্য? এ প্রশ্নের মীমাংসায় রামমোহন বলেছিলেন, বিভিন্ন ধর্মের ভেতরে পরস্পরবিরোধী অনেক নিত্যবিধি বর্তমান। তাই সব ধর্মই সত্য এ কথা মানা যায় না। তবে সব ধর্মের ভেতরেই সত্য আছে। দেবেন্দ্রনাথ রামমোহনের এই মীমাংসা মেনে চলেছিলেন বলতে পারা যায় যদিও উপনিষদের দিকে তিনি বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। কিন্তু কেশবচন্দ্রের ভক্তি প্রধান প্রকৃতির কাছে রাজার এ মীমাংসা ব্যর্থ হলো। তিনি বললেন-‘Our position is not that there are truths in all religions, but that all established religions of the world are true.’ এই কথাই রামকৃষ্ণ আরও সোজা করে বললেন- ‘যত মত তত পথ’। যত মত তত পথ তা নিশ্চয়ই; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- সেসব পথ একই গন্তব্য স্থানে নিয়ে যায় কিনা। রামকৃষ্ণ বললেন- ‘হাঁ তাই যায়।’ তিনি সাধনা করে দেখেছেন, শাক্ত, বৈষ্ণব, বেদান্ত, সুফী, খ্রীস্টান ইত্যাদি সব পথই এক ‘অখ- সচ্চিদানন্দের অনুভূতিতে নিয়ে যায়। এসব কথার সামনে তর্ক বৃথা। তবে একটি কথা বলা যেতে পারে যে, মানুষ অনেক সময়ে বেশি করে যা ভাবে চোখেও সে তাই দেখে।
৭.
বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মচর্চার উপরে যে একটা মধ্যযুগীয় ছাপ মারা রয়েছে তা আমরা দেখেছি। কিন্তু বাংলার নব বিকশিত সাহিত্যে যেন এই ত্রুটির স্খলনের চেষ্টা প্রথম থেকেই হয়ে আসছে। বাংলার নব সাহিত্যের নেতা মধুসূদন আশ্চর্য উদারচিত্ত নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জাতি ধর্ম ইত্যাদির সংকীর্ণতা যেন জীবনের ক্ষণকালের জন্যও তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নাই; আর এই উদারচিত্ত কবি ইউরোপের ও ভারতের প্রাচীন কাব্যকলার শেষ্ঠ সম্পদ যেভাবে অবলীলাক্রমে আহরণ করে তাঁর স্বদেশবাসীদের উপহার দিয়েছেন সে কথা বাঙালী চিরদিনই বিস্ময় ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। বাঙালী তাঁর পরে সাহিত্যের যে নেতা বাঙালী জীবনের ওপর একটা অক্ষয় ছাপ রেখে গেছেন তিনিও প্রথম জীবনে শিল্পী, সুতরাং, সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা অস্পৃষ্ট। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের ভেতর কবিজনসুলভ স্বপ্ন কম। তিনি বরং নিপুণ চিত্রকর ও বাস্তববাদী স্বদেশ প্রেমিক। তাই তাঁর যে অমর কীর্তি ‘আনন্দ মঠ’ তাতে হয়ত নায়ক নায়িকার গূঢ় আনন্দ-বেদনার রেখাপাত নাই, হয়ত এমন কোন সৌন্দর্য মূর্তি আঁকা হয় নাই, যা শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে’ মানুষের নয়নে প্রতিভাত হবে অ ঃযরহম ড়ভ নবধঁঃু আর সেই জন্য ধ লড়ু ভড়ৎ বাবৎ কিন্তু তবু এটি আমর এই জন্য যে, এতে যেন লেখক কি একটা আশ্চর্য ক্ষমতায় পাঠকের সামনে প্রসারিত করে ধরেছেন, দেশের দুর্দশা মথিত তাঁর রক্তাক্ত হৃদয়- যে হৃদয় তাঁর সুগভীর বাস্তবতার জন্যই সৌন্দর্যের এক রহস্যময় খনি। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র শেষ পর্যন্ত শিল্পের ক্ষেত্রে থাকতে পারেন নাই; শেষ বয়সে ধর্মের ক্ষেত্রে তিনি অবতরণ করেছিলেন। তাঁর চরিতাখ্যায়করা বলেন, শেষ বয়সে আত্মীয় বিয়োগে অধীর হয়ে তিনি ধর্মে মনোনিবেশ করেন।
________________________________
কাজী আবদুল ওদুদ
ওদুদ, কাজী আবদুল (১৮৯৪- ১৯৭০) শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ। জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। পিতা কাজী সৈয়দ হোসেন। তিনি পেশায় ছিলেন রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার। মাতা খোদেজা খাতুন।
কাজী আবদুল ওদুদ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৩ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ১৯১৫ সালে আই-এ এবং ১৯১৭ সালে বি এ পাস করেন। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পলিটিক্যাল ইকোনমিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এমএ পাস করার অব্যবহিত পরেই তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কিছুদিন একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর ১৯২০ সালে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বাংলার প্রভাষকের পদে যোগদান করেন এবং ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এ কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪০ সালে বাংলা সরকার প্রাদেশিক টেক্সটবুক কমিটির সেক্রেটারি ও রীডারের পদ সৃষ্টি করলে তিনি উক্ত পদে নিয়োগ লাভ করে কলকাতায় শিক্ষাদফতরে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উক্ত পদের সঙ্গে রেজিস্টার অব পাবলিকেশন্স পদটি যুক্ত করে। কাজী আবদুল ওদুদ এ গুরুত্বপূর্ণ পদে এগারো বছর কর্মরত থাকার পর ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে অবসর গ্রহণ করেন।
কলেজে অধ্যয়নকালেই কাজী আবদুল ওদুদ সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ছাত্র অবস্থায়ই তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ মীর পরিবার (১৯১৮) এবং উপন্যাস নদীবক্ষে (১৯১৯) প্রকাশিত হয়। এমএ পাস করার পর তিনি কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আবাসিক ভবনে কিছুদিন অবস্থান করেন। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এখানেই। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে সাহিত্যিকদের আড্ডা বসত। যুদ্ধফেরত নজরুলের উপস্থিতিতে সে আড্ডা আরও বেগবান হয়ে ওঠে। কাজী আবদুল ওদুদের লেখক জীবনের ভিত্তি গড়ে ওঠে এ কবি-সাহিত্যিকদের সাহচর্যেই। তবে তাঁর চিন্তা ও চেতনাকে পরিণতি দান করে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজ (১৯২৬)। সাহিত্য-সমাজের মুখপত্র শিখার প্রতিটি সংখ্যার পরিকল্পনা ও প্রকাশনায় আবুল হুসেনের সঙ্গে তাঁর সক্রিয় প্রয়াসপ্রযত্ন ছিল। তবে কাজী আবদুল ওদুদের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে সংকল্প (১৩৬১) ও তরুণপত্র (১৩৭২) নামে দুটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন প্রথমটির সম্পাদক এবং দ্বিতীয়টির সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারায় কাজী আবদুল ওদুদের প্রধান পরিচয় চিন্তাশীল লেখক হিসেবে। তবে তাঁর লেখালেখি শুরু হয় কথাসাহিত্যের মাধ্যমে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ মীর পরিবার পাঁচটি গল্পের সংকলন। এরপর তিনি তিনটি গল্প রচনা করেন যা পরবর্তী সময়ে তরুণ (১৯৪৮) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। নদীবক্ষে ও আজাদ (১৯৪৮) তাঁর দু’টি উপন্যাস। নাটকও রচনা করেন দু’টি, পথ ও বিপথ (১৯৩৯) এবং মানব-বন্ধু (১৯৪১)। মানব-বন্ধু পরবর্তীকালে তরুণ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়।
কাজী আবদুল ওদুদের কয়েকটি গ্রন্থ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। তাঁর মননশীলতা এবং বৈদগ্ধের প্রকাশ লক্ষ করা যায় শাশ্বত বঙ্গ (১৯৫১) বাংলার জাগরণ (১৩৬৩), কবিগুরু গ্যেটে (১ম ও ২য় খন্ড ১৩৫৩), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ (১ম খন্ড ১৩৬৯, ২য় খন্ড ১৩৭৬), হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম (১৩৭৩) গ্রন্থে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকায় যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সংঘটিত হয়, যাঁরা মুসলিম সাহিত্য-সমাজ নামে পরিচিত ছিলেন, কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন এ আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বিচার-বুদ্ধিকে সংস্কার মুক্ত ও গতিশীল করার প্রচেষ্টায় যে সকল চিন্তা ও বক্তব্য নিয়ে কাজী আবদুল ওদুদ ও তাঁর সহকর্মীদের অগ্রসর হতে দেখা যায়, শাশ্বত বঙ্গ তার একটি মূল্যবান দলিল। তাঁর উদারনৈতিক মনোভাব এবং নিজের সমাজ ও সম্প্রদায়ের দৈন্যের জন্য আক্ষেপ এ গ্রন্থের আর একটি দিক। পরিবেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গভীর ভালোবাসার, প্রেম তাঁর বক্তব্যের এক প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। শাশ্বত বঙ্গ তাই সাজাত্যবোধে উজ্জ্বল। তাঁর শাশ্বত বঙ্গ অনৈতিহাসিক সোনার বাংলা এবং আদর্শায়িত রূপকথার কাহিনী নয়। প্রকৃতপক্ষে এ বঙ্গে মানুষের জীবন দীনহীন ও নানা সংস্কারে পীড়িত। অনগ্রসরতার গ্লানি তাঁর নিত্য সঙ্গী। কিন্তু সে দীনতাকে চিরস্থায়ী বলে মনে করেন না তিনি। তাঁর বঙ্গ সৃষ্টিশীল ও সম্ভাবনাময়।
এ বঙ্গদেশে, কাজী আবদুল ওদুদ মনে করতেন, উনিশ শতকে একটি রেনেসাঁস সংঘটিত হয়, যার একটি বড় বক্তব্য ছিল, স্বদেশপ্রেমে দোষ নেই যতক্ষণ স্বাদেশিকতা না হয় বিশ্ববিমুখ। তাঁর বাংলার জাগরণ বিষয়ক আলোচনার এক প্রধান প্রেরণা ছিল এটা। এ প্রেরণায় তিনি লিখেছেন বাংলার জাগরণ গ্রন্থ। তাঁর মতে রামমোহন থেকে ঢাকার ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন পর্যন্ত যে প্রয়াস, সেটা এ প্রেরণার ফল। অন্যদিকে তাঁর কবিগুরু গ্যেটে গ্রন্থের বক্তব্যও এ প্রেরণাজাত। গ্যেটের স্বচ্ছ ও সবল মুক্তবুদ্ধি এদেশের মানুষকেও সাহায্য করবে জীবনের দায়িত্ব, প্রতিভা, ধর্ম, স্বদেশপ্রেম, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের অর্থ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রকে বাড়িয়ে তুলতে। তিনি অনুপ্রাণিত হন গ্যেটের সত্যাশ্রয়ী ব্যাপক জীবনবোধ ও বিশ্ববোধের মন্ত্রে ও দৃষ্টান্তে।
কাজী আবদুল ওদুদ স্বদেশচেতনার সঙ্গে বিশ্বচেতনার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত লক্ষ করেন রবীন্দ্রনাথের জীবনে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও কর্মক্ষেত্রের নিবিষ্ট পাঠক ও আলোচক ছিলেন তিনি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর গভীর সাহিত্যবোধ ও ব্যাপক মননশীলতার পরিচয়বাহী গ্রন্থ। হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম তাঁর পরিণত বয়সের রচনা। তিনি এ গ্রন্থে হজরত মোহাম্মদকে রক্ত-মাংসের মানুষ এবং ঐতিহাসিক এক সঙ্কটকালের মহৎ পুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করেন। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সমগ্র মানবজাতির প্রতি যাঁর ছিল অপরিসীম দরদ ও দায়িত্ব। হজরত মোহাম্মদ মানবজাতির মুক্তির লক্ষ্যে সাম্যদৃষ্টি ও জ্ঞানানুরাগের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কাজী আবদুল ওদুদ এ বক্তব্যটি তাঁর উক্ত গ্রন্থে বিশেষভাবে তুলে ধরেন।
১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় কাজী আবদুল ওদুদের ব্যবহারিক শব্দকোষ। আধুনিক বাংলা ভাষার একটি জনপ্রিয় অভিধান সংকলনে তাঁর ভাষা সচেতন মনের পরিচয় মেলে এখানে। অভিধানটির বিশেষত্ব হলো, এতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আরবি, ফার্সি ও তুর্কি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণের প্রয়াস আছে এবং বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত শব্দসমূহ অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে।
কাজী আবদুল ওদুদের অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, প্রবন্ধ ও সাহিত্যসমালোচনা: নবপর্যায় (১ম খন্ড ১৩৩৩, ২য় খন্ড ১৩৩৬), সমাজ ও সাহিত্য (১৩৪১), হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ (১৩৪২), Fundamentals of Islam (১৩৫৭), State and Literature (১৩৬৪), Tagore’s Role in the Reconstruction of Indian Thought(১৩৬৮), আজকার কথা (১৩৪৮), স্বাধীনতা দিনের উপহার (১৩৫৮), রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৩৩৪), নজরুল-প্রতিভা (১৩৫৬), শরৎচন্দ্র ও তারপর (১৩৬৮); জীবনীগ্রন্থ: অনুবাদ গ্রন্থ: Creative Bengal (১৩৫৭), পবিত্র কোরআন (১ম ভাগ ১৩৭৩, ২য় ভাগ ১৩৭৪)। এ ছাড়া রয়েছে কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলী (১ম খন্ড ১৯৮৮, ২য় খন্ড ১৯৯০, ৩য় খন্ড ১৯৯২, ৪র্থ খন্ড ১৯৯৩, ৫ম খন্ড ১৯৯৪ ও ৬ষ্ঠ খন্ড ১৯৯৫) এবং কাজী আবদুল ওদুদের পত্রাবলী (১৯৯৯)।
কাজী আবদুল ওদুদের গদ্যের প্রধান ভিত্তি যুক্তি, পরিমিতিবোধ এবং আত্মপ্রত্যয়। বাংলা গদ্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই ত্রিবিধ গুণসম্পন্ন বাংলা রচনার উদাহরণ খুব বেশি নেই। তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁকে বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট গদ্যশিল্পীরূপে চিহ্নিত করা যায়। পশ্চাদপদ বাঙালি মুসলমান সমাজে মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে কাজী আবদুল ওদুদের অবদান বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। ১৯৭০ সালের ১৯ মে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
বাংলার জাগরন:
আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির ধারণা এই যে, বাংলার জাগরণ পাশ্চাত্য প্রভাবের ফল। কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু পুরোপুরি সত্যও যে নয় সে দিকটা ভেবে দেখবার আছে। যাঁরা এই জাগরণের নেতা তাঁরা কি উদ্দেশ্য আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ও এই জাগরণের ফলে দেশের যা লাভ হয়েছে তার স্বরূপ কি, এই সমস্ত চিন্তা করলে হয়ত আমাদের কথা ভিত্তিশূন্য মনে হবে না। রাজা রামমোহন রায়ের ব্রহ্মজ্ঞান প্রচার থেকে আরম্ভ করে বাজনা ও গো-হত্যা নিয়ে হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গা পর্যন্ত আমাদের দেশের চিন্তা ও কর্মধারা, আর ডিইস্ট এনসাইক্লোপিডিস্ট থেকে আরম্ভ করে বোলশেভিজম পর্যন্ত পাশ্চাত্য চিন্তা ও কর্মধারা এই দুইয়ের উপর চোখ বুলিয়ে গেলেও বুঝতে পারা যায়- আমাদের দেশ তার নিজের কর্মফলের বোঝাই বহন করে চলেছে পাশ্চাত্যর সঙ্গে তার পার্থক্য যথেষ্ট লক্ষ্যযোগ্য। এই পার্থক্য এই সঙ্গে আমাদের জন্য আনন্দের ও বিষাদের। আনন্দের এই জন্য যে, এতে করে আমাদের একটা বিশিষ্ট সত্তার পরিচয় আমরা লাভ করি অসভ্য বা অর্ধসভ্য জাতির মতো আমরা শুধু ইউরোপের প্রতিধ্বনি মাত্র নই; আর বিষাদের এই জন্য যে আমাদের জাতীয় চিন্তা ও কর্ম-পরম্পরার ভেতর দিয়ে আমাদের যে ব্যক্তিত্ব সুপ্রকট হয়ে ওঠে সেটি অতীতের অশেষ অভিজ্ঞতা পুষ্ট অকুতোভয় আধুনিক মানুষের ব্যক্তিত্ব নয়, সেটি অনেকখানি অল্প পরিসর শাস্ত্রশাসিত মধ্যযুগীয় মানুষের ব্যক্তিত্ব।
২.
বাংলার নবজাগরণের প্রভাত-নক্ষত্র যে রাজা রামমোহন রায় সে সম্বন্ধে কোন মতভেদ নাই। কিন্তু তাকে জাতীয় জাগরণের প্রভাত নক্ষত্র না বলে প্রভাত সূর্য্য বলাই উচিত, কেননা, জাতীয় জীবনের কেবল মাত্র একটি নব চৈতন্যের সাড়াই তার ভেতরে অনুভূত হয় না, সেইদিনে এমন একটি বিরাট নব আদর্শ তিনি জাতির সামনে উপস্থাপিত করে গেছেন যে, এই শত বছরেও আমাদের দেশে আর দ্বিতীয় ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন নাই যার আদর্শ রামমোহনের আদর্শের সঙ্গে তুলিত হতে পারে। এমন কি, এই শত বছরে আমাদের দেশে অন্যান্য যে সমস্ত ভাবুক ও কর্মী জন্মেছেন তাঁদের প্রয়াসকে পাদপীঠরূপে ব্যবহার করে তার উপর রামমোহনের আদর্শের নবপ্রতিষ্ঠা করলে দেশের জন্য একটা সত্যিকার কল্যাণের কাজ হবে এই আমাদের বিশ্বাস। এই রামমোহন যে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, পাশ্চাত্য জীবনাদর্শ ইত্যাদির দিকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নাই। তবু এ কথা সত্য যে, এই পাশ্চাত্য কৃষ্টির সংস্রবে তিনি এসেছিলেন পূর্ণযৌবনে। তার আগে আরবী-ফার্সী ও সংস্কৃত অভিজ্ঞ রামমোহন পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে পিতা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে বাদানুবাদ করেছেন, গৃহত্যাগ করে তিব্বত, উত্তর ভারত ভ্রমণ করেছেন, আর সেই অবস্থায় নানক, কবীর প্রভৃতি ভক্তদের ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন- যাঁরা হিন্দু-চিন্তার উত্তরাধিকার স্বীকার করেও পৌত্তলিকতা, অবতারবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ৩.
রামমোহন জাতীয় জীবনে যে সমস্ত কর্মের প্রবর্তনার সঙ্কলন করেছিলেন তার মধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দু কলেজ অনতিবিলম্বে ফল প্রসব করতে আরম্ভ করে। হিন্দু কলেজের সঙ্গে ডিরোজিও’র নাম চিরদিনের জন্য একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। এই ডিরোজিও যে গুরুর শিষ্য ‘ফরাসী’ বিপ্লবের চিন্তার স্বাধীনতা বহ্নি তাঁর ভেতরে প্রজ্বলিত ছিল। ডিরোজিও’র সেই বহ্নি-দীক্ষা হয়েছিল। অল্প বয়সে যথেষ্ট বিদ্যা অর্জন করে কবি ও চিন্তাশীলরূপে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। বিশ বছর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজের চতুর্থ শিক্ষকরূপে নিয়োজিত হন, আর তিন বছর শিক্ষকতা করার পর সেখান থেকে বিতাড়িত হন। এরই ভেতর তাঁর শিষ্যদের চিত্তে যে আগুন তিনি জ্বালিয়ে দেন তাঁর কলেজ পরিত্যাগের পরও বহুদিন পর্যন্ত তাঁর তেজ মন্দিভূত হয় নাই। শুধু তাই নয়, নব্যবঙ্গের গুরুদের ভেতর এই ডিরোজিত্ত’র এক বিশিষ্ট স্থান আছে। এর শিষ্যরা অনেকেই চরিত্র, বিদ্যা, সত্যানুরাগ ইত্যাদির জন্য জাতীয় জীবনে গৌরবের আসন লাভ করেছিলেন, এরইসঙ্গে হিন্দু সমাজের আচার-বিচার, বিধি-নিষেধ ইত্যাদির লঙ্ঘন দ্বারা সুনাম বা কুনাম অর্জন করে সমস্ত সমাজের ভেতরে একটা নব মনোভাবের প্রবর্তনা করেন।
৪.
রামমোহনের শ্রেষ্ঠ দান কী তা নিয়ে আগেও বাংলাদেশে তর্ক-বির্তক হয়েছে, ভবিষ্যতের জন্যও যে সে তর্ক-বিতর্কের প্রয়োজনীয়তা চুকে গেছে তা নয়। তবে যে সমস্ত বাদ প্রতিবাদ হয়েছে তার মধ্যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অক্ষয় কুমার দত্তের বাদানুবাদই সুবিখ্যাত। দেবেন্দ্রনাথ ঈশ্বর-প্রেমিক পরুষ ছিলেন। হাফেজের যেসব লাইন তাঁর অতি প্রিয় ছিল তার একটি এই- হরগিজম মোহরে তু আজ লওহে দিল ও জাঁ না বরদ। তাঁর জীবনের সমস্ত সম্পদ বিপদের ভেতর দিয়ে তাঁকে এই প্রেমের পরিচয় তাঁর দেশবাসীরা পেয়েছেন। প্রথম জীবনেই যে পরীক্ষায় তাঁকে উত্তীর্ণ হতে হয়েছিল তা কঠোর-সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে সর্বস্ব দানে তিনি পিতৃঋণ হতে উদ্ধার পাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। সত্যের যাত্রাপথে ‘মহান মৃত্যু’র এমননিভাবে সম্মুখীন হওয়া সমস্ত বাঙালী জীবনে এক মহা ঘটনা যাকে বেষ্টন করে বাংলার ভাবস্রোতের নৃত্য চলতে পারে হয়ত চলেছে। কিন্তু গুহাপথের যাত্রী হয়েও দেবেন্দ্রনাথ গভীরভাবে জ্ঞানানুরাগী ও সৌন্দর্যানুরাগী ছিলেন। তবু সংসারনিষ্ঠা, জ্ঞানানুশীলন, সৌন্দর্যস্পৃহা, সমস্তের ভেতরে ঈশ্বরপ্রেমই ছিল তার অন্তরের অন্তরতম বস্তু। তাই তিনি যে রামমোহনকে মুখ্যত ব্রহ্মজ্ঞানের প্রচারকরূপে দেখবেন এটাই স্বাভাবিক।
৫.
আমরা বলেছি বাংলায় এ পর্যন্ত যে চিন্তা ও কর্মধারার বিকাশ হয়েছে তাতে মধ্যযুগীয় প্রভাব বেশি। দেবেন্দ্রনাথের কাব্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তিনি মানুষের চিত্তকে বহ্ম পাদপীঠ বলে সম্মান দিয়েছেন। শুধু প্রাচীন ঋষিদের যে কেবল সে অধিকার ছিল তা তিনি মানেন নাই। কিন্তু এই আবিষ্কৃত সত্যের পুরো ব্যবহারে তিনি যেন কেমন সঙ্কোচবোধ করেছেন। এই ‘আত্মপ্রত্যয়-সিদ্ধ জ্ঞানোজ্জ্বলিত বিশুদ্ধ হুদয়’ কথাটি তিনি পেয়েছিলেন উপনিষদ থেকে- নিজের জীবনের ভেতরে এ কথার সায় তিনি নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন। কিন্তু অন্তত প্রয়োজনতাড়িত মানুষকে এই অমৃতের সাধনা জীবনের সমস্ত কর্ম সমস্ত অবসর, সমস্ত প্রার্থনা, সমস্ত অপ্রার্থনার ভেতর দিয়ে করতে হবে শুধু বিধিবদ্ধ প্রার্থনার ভেতর দিয়েই নয়- এতটা অগ্রসর হতে তিনি যেন পশ্চাদপদ হয়েছেন। হয়ত বৃহত্তর মনীষা নিয়ে তিনি যদি অক্ষয় কুমারকে আত্মসাত করতে পারতেন তাহলে ব্রাহ্ম সমাজ তাঁর হাতে যে রূপ লাভ করত তা দেশের পক্ষে আরও কল্যাণদায়ক হতো।
৬.
সব ধর্মই কি সত্য? এ প্রশ্নের মীমাংসায় রামমোহন বলেছিলেন, বিভিন্ন ধর্মের ভেতরে পরস্পরবিরোধী অনেক নিত্যবিধি বর্তমান। তাই সব ধর্মই সত্য এ কথা মানা যায় না। তবে সব ধর্মের ভেতরেই সত্য আছে। দেবেন্দ্রনাথ রামমোহনের এই মীমাংসা মেনে চলেছিলেন বলতে পারা যায় যদিও উপনিষদের দিকে তিনি বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। কিন্তু কেশবচন্দ্রের ভক্তি প্রধান প্রকৃতির কাছে রাজার এ মীমাংসা ব্যর্থ হলো। তিনি বললেন-‘Our position is not that there are truths in all religions, but that all established religions of the world are true.’ এই কথাই রামকৃষ্ণ আরও সোজা করে বললেন- ‘যত মত তত পথ’। যত মত তত পথ তা নিশ্চয়ই; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- সেসব পথ একই গন্তব্য স্থানে নিয়ে যায় কিনা। রামকৃষ্ণ বললেন- ‘হাঁ তাই যায়।’ তিনি সাধনা করে দেখেছেন, শাক্ত, বৈষ্ণব, বেদান্ত, সুফী, খ্রীস্টান ইত্যাদি সব পথই এক ‘অখ- সচ্চিদানন্দের অনুভূতিতে নিয়ে যায়। এসব কথার সামনে তর্ক বৃথা। তবে একটি কথা বলা যেতে পারে যে, মানুষ অনেক সময়ে বেশি করে যা ভাবে চোখেও সে তাই দেখে।
৭.
বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মচর্চার উপরে যে একটা মধ্যযুগীয় ছাপ মারা রয়েছে তা আমরা দেখেছি। কিন্তু বাংলার নব বিকশিত সাহিত্যে যেন এই ত্রুটির স্খলনের চেষ্টা প্রথম থেকেই হয়ে আসছে। বাংলার নব সাহিত্যের নেতা মধুসূদন আশ্চর্য উদারচিত্ত নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জাতি ধর্ম ইত্যাদির সংকীর্ণতা যেন জীবনের ক্ষণকালের জন্যও তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নাই; আর এই উদারচিত্ত কবি ইউরোপের ও ভারতের প্রাচীন কাব্যকলার শেষ্ঠ সম্পদ যেভাবে অবলীলাক্রমে আহরণ করে তাঁর স্বদেশবাসীদের উপহার দিয়েছেন সে কথা বাঙালী চিরদিনই বিস্ময় ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। বাঙালী তাঁর পরে সাহিত্যের যে নেতা বাঙালী জীবনের ওপর একটা অক্ষয় ছাপ রেখে গেছেন তিনিও প্রথম জীবনে শিল্পী, সুতরাং, সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা অস্পৃষ্ট। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের ভেতর কবিজনসুলভ স্বপ্ন কম। তিনি বরং নিপুণ চিত্রকর ও বাস্তববাদী স্বদেশ প্রেমিক। তাই তাঁর যে অমর কীর্তি ‘আনন্দ মঠ’ তাতে হয়ত নায়ক নায়িকার গূঢ় আনন্দ-বেদনার রেখাপাত নাই, হয়ত এমন কোন সৌন্দর্য মূর্তি আঁকা হয় নাই, যা শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে’ মানুষের নয়নে প্রতিভাত হবে অ ঃযরহম ড়ভ নবধঁঃু আর সেই জন্য ধ লড়ু ভড়ৎ বাবৎ কিন্তু তবু এটি আমর এই জন্য যে, এতে যেন লেখক কি একটা আশ্চর্য ক্ষমতায় পাঠকের সামনে প্রসারিত করে ধরেছেন, দেশের দুর্দশা মথিত তাঁর রক্তাক্ত হৃদয়- যে হৃদয় তাঁর সুগভীর বাস্তবতার জন্যই সৌন্দর্যের এক রহস্যময় খনি। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র শেষ পর্যন্ত শিল্পের ক্ষেত্রে থাকতে পারেন নাই; শেষ বয়সে ধর্মের ক্ষেত্রে তিনি অবতরণ করেছিলেন। তাঁর চরিতাখ্যায়করা বলেন, শেষ বয়সে আত্মীয় বিয়োগে অধীর হয়ে তিনি ধর্মে মনোনিবেশ করেন।









No comments:
Post a Comment