‘ডাহুক’

‘ডাহুক’ ফররুখ আহমদ। https://www.facebook.com/abdullahmandal325.mobi/ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক প্রতিভার অধিকারী শক্তিমান কবি ফররুখ আহমদ। তিনি বৃহত্তর যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) অন্তর্গত মাঝআইল গ্রামে ১৯১৮ সনের ১০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সনের ১৯ অক্টোবর তিনি ঢাকায় ইন্তিকাল করেন। বাংলা কাব্যে তাঁর অবদান বিপুল ও নানা বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে অনন্যসাধারণ। ফররুখ আহমদকে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করার প্রয়াস পেয়েছেন। কেউ তাঁকে ‘ইসলামী রেনেসাঁর কবি' কেউ ‘মুসলিম নবজাগরণের কবি', কেউ ‘মানবতাবাদী কবি' ইত্যাদি নানা অভিধায় বিশেষায়িত করেছেন। এর কোনটিই অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রত্যেকের মূল্যায়নই তথ্যভিত্তিক, যুক্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফররুখ এক ও অবিভাজ্য-আলাদা আলাদাভাবে তাঁকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ নেই। ফররুখের নিকট ‘ইসলাম', মুসলিম', ‘মানবতাবাদ', এসবই মুদ্রার বিভিন্ন দিক মাত্র। তিনি দৃঢ়ভাবে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং গভীর নিষ্ঠার সাথে তাঁর জীবনে ও কর্মে এর প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। ইসলামে বিশ্বাসের কারণেই তিনি মুসলিম জাতির নবজাগরণ প্রত্যাশা করেছেন এবং ইসলাম থেকেই তিনি মানবতাবাদের প্রেরণা লাভ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইসলাম আল্লাহ-প্রদত্ত এক অভ্রান্ত জীবনাদর্শ। একমাত্র ইসলামই মানবজাতির সকল সমস্যার সুষ্ঠু, সুন্দর সমাধান দিতে সক্ষম। এতে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল মানুষের মুক্তি ও কল্যাণ সুনিশ্চিত। সে কারণেই তিনি একাধারে ইসলামে বিশ্বাসী, মুসলিম নবজাগরণের নকীব ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রবক্তা। ইসলামী রেনেসাঁর কবি হিসাবে খ্যাত হলেও ফররুখ তাঁর কাব্য-কবিতায় সরাসরি ইসলামের কথা উচ্চারণ করেননি। প্রতীক ও রূপকল্পের মাধ্যমে তিনি তাঁর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কাব্য-ভাষায়, অসাধারণ কাব্য-কুশলতায় যে বলিষ্ঠ ভাব ও আবেদন ফুটিয়ে তুলেছেন, তা ইসলামের ব্যঞ্জনাকেই প্রমূর্ত করে তোলে। এখানেই তাঁর অনন্যসাধারণ কৃতিত্ব ও বিস্ময়কর প্রতিভার মহিমাময় অত্যুজ্জ্বল প্রকাশ। আধুনিক বাংলা কাব্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩) থেকে সমুদগত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে (১৮৬১-১৯৪১) এসে পরিণতরূপ লাভ করেছে। কাজী নজরুল ইসলামে (১৮৯৯-১৯৭৬) তা নতুন বাঁক নিয়েছে। ভাব-বিষয়, ভাষা-ব্যঞ্জনায় নজরুল-কাব্য এক অভিনব অভিব্যঞ্জনা লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের সমকালেই পাশ্চাত্য কাব্যাদর্শে অনুপ্রাণিত তিরিশের কবিরা বাংলা কাব্যে আরেক নতুন সুর ও অনুরণন সৃষ্টি করেছেন। তিরিশের উজ্জ্বলতম কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাস (১৮৯৯-১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬১), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-৮৬), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-৮৮), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪), বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২), সমর সেন (১৯১৬-৮৭) প্রমুখ স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হওয়া সত্ত্বেও সকলেই চেয়েছিলেন রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে মুক্তি। তাঁরা নজরুলের কাব্যিক উচ্চারণ ও উত্তাপে অনুপ্রাণিত হওয়া সত্ত্বেও নজরুলের ভাব-ভাষার সাথে তাঁরা কখনো সাজুয্য খুঁজে পাননি। নজরুল তাঁর ভিন্ন সামাজিক পটভূমি ও বিশ্বাসের কারণেই তিনি অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন। তিরিশোত্তর যুগে বাংলা কাব্যে আরেক ভিন্ন ধারার কবি জসীমউদ্দীন (১৯০৩-৭৬)। তিনি এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধারার অনুসারী বা প্রবর্তক। তিনি পল্লী-জীবনের চিত্র, পল্লীর সাধারণ মানুষ, ভাব ও বিষয়কে ধারণ করে সাধারণ গণ-মানুষের ভাষায় তাঁর কাব্যের বিচিত্র ভুবন রচনা করেছেন। নজরুলের সাথে তাঁর কিছুটা সাজুয্য থাকলেও ভাব-ভাষা-উচ্চারণ ও কাব্যিক স্নিগ্ধতায় তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক উজ্জ্বল কবি-প্রতিভা। বাংলা সাহিত্যে তিনি ‘পল্লীকবি' হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করলেও মূলত তিনি একজন নিজস্ব ধারার আধুনিক কবি। কাব্য-ক্ষেত্রে ফররুখ আহমদের যখন আবির্ভাব-তখন রবীন্দ্রনাথের জীবনাবসান ঘটেছে, নজরুল বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। জসীমউদ্দীন ও তিরিশোত্তর যুগের কবিদের তখন প্রবল দাপট চলছে। তা সত্ত্বেও ফররুখ আহমদ তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয়ে সকলের সপ্রসংশ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর এ বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়েছে কাব্যের বিচিত্র রূপরীতি, শিল্প-নৈপুণ্য, রূপক-উপমা-প্রতীক-রূপকল্পের অভিনব ব্যবহার ও নিজস্ব কাব্য-ভাষা নির্মাণের অসাধারণ সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে। তিনি একাধারে গীতি কবিতা, সনেট, ব্যঙ্গ কবিতা, গান-গজল, শিশুতোষ কাব্য, মহাকাব্য, কাব্যনাট্য, গীতিনাট্য, ব্যঙ্গনাট্য ইত্যাদি রচনা করেছেন। তিনি মূলত রোমান্টিক, কিন্তু তাঁর কিছু কিছু কাব্য কবিতায় ধ্রুপদ বৈশিষ্ট্যের ছাপ স্পষ্ট। ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র হিসাবে তিনি একাধারে আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের শিল্প-বৈশিষ্ট্যের সাথে আধুনিক বাংলা কাব্যের উজ্জ্বলতম শিল্প-বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটিয়ে সফল কাব্য-চর্চায় ব্রতী হয়েছেন। রাত্রিভ’র ডাহুকের ডাক.... এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির! দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি। ছলনার পাশা খেলা আজ প’ড়ে থাক, ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি, কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক। তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে ক্রমাগত ভেসে ভেসে পালক মেঘের অন্তরালে, অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে স্বপ্নের প্রবাল। অবিশ্রাম ঝ’রে ঝ’রে পড়ে শিশির পাখার ঘুম, গুলে বকৌলির নীল আকাশ মহল হ’য়ে আসে নিসাড় নিঝুম, নিভে যায় কামনা চেরাগ; অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক। কোন্ ডুবুরির অশরীরী যেন কোন্ প্রচ্ছন্ন পাখীর সামুদ্রিক অতলতা হ’য়ে মৃত্যু-সুগভীর ডাক উঠে আসে, ঝিমায় তারার দীপ স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাশে আকাশে। তুমি কি এখনো জেগে আছো? তুমি কি শুন্ছো পেতে কান? তুমি কি শুন্ছো সেই নভঃগামী শব্দের উজান? ঘুমের নিবিড় বনে সেই শুধু সজাগ প্রহরী! চেতনার পথ ধরি চলিয়াছে তার স্বপ্ন-পরী, মন্থর হাওয়ায়। সাথী তন্দ্রাতুর। রাত্রির পেয়ালা পুরে উপচিয়া প’ড়ে যায় ডাহুকের সুর। শুধু সুর বাসে বেতস বনের ফাঁকে চাঁদ ক্ষ’য়ে আসে রাত্রির বিষাদ ভরা স্বপ্নাচ্ছন্ন সাঁতোয়া আকাশে। মনে হয় তুমি শুধু অশরীরী সুর! তবু জানি তুমি সুর নও, তুমি শুধু সুরযন্ত্র। তুমি শুধু বও আকাশ-জমানো ঘন অরণ্যের অন্তর্লীন ব্যথাতুর গভীর সিন্ধুর অপরূপ সুর... অফুরান সুরা... ম্লান হ’য়ে আসে নীল জোছনা বিধুর ডাহুকের ডাকে! হে পাখী! হে সুরাপাত্র! আজো আমি চিনিনি তোমাকে। হয়তো তোমাকে চিনি, চিনি ঐ চিত্রিত তনুকা, বিচিত্র তুলিতে আঁকা বর্ণ সুকুমার। কিন্তু যে অপূর্ব সুরা কাঁদাইছে রাত্রির কিনার যার ব্যথা-তিক্ত রসে জ’মে ওঠে বনপ্রান্তে বেদনা দুঃসহ, ঘনায় তমালে, তালে রাত্রির বিরহ সেই সুর পারি না চিনিতে। মনে হয় তুমি শুধু সেই সুরাবাহী পাত্র ভরা সাকী। উজাড় করিছ একা সুরে ভরা শারাব-সুরাহি বনপ্রান্তে নিভৃত একাকী। হে অচেনা শারাবের ‘জাম’! যে সুরার পিপাসায় উন্মুখ, অধীর অবিশ্রাম সূর্যের অজানা দেশে তারার ইশারা নিয়ে চলিয়াছ এক মনে ভেসে সুগভীর সুরের পাখাতে, স্তব্ধ রাতে বেতস প্রান্তর ঘিরে তিমিরি সমুদ্র ছিঁড়ে চাঁদের দুয়ারে; যে সুরার তীব্র দাহে ভেসে চলো উত্তাল পাথারে, প্রান্তরে তারার ঝড়ে সেই সুরে ঝ’রে পড়ে বিবর্ণ পালক, নিমেষে রাঙায়ে যায় তোমার নিষ্প্রভ তনু বিদ্যুৎ ঝলক, তীর তীব্র গতি নিয়ে ছুটে যায় পাশ দিয়ে উল্কার ইশারা, মৃত অরণ্যের শিরে সমুদ্রের নীল ঝড় তুলে যায় সাড়া উদ্দাম চঞ্চল; তবু অচপল গভীর সিন্ধুর সুদুর্গম মূল হ’তে তোলো তুমি রাত্রি ভরা সুর। ডাহুকের ডাক... সকল বেদনা যেন সব অভিযোগ যেন হ’য়ে আসে নীরব নির্বাক। রাত্রির অরণ্যতটে হে অশ্রান্ত পাখী! যাও ডাকি ডাকি অবাধ মুক্তির মত। ভারানত আমরা শিকলে, শুনি না তোমার সুর, নিজেদেরি বিষাক্ত ছোবলে তনুমন করি যে আহত। এই ম্লান কদর্যের দলে তুমি নও, তুমি বও তোমার শৃঙ্খলমুক্ত পূর্ণ চিত্তে জীবন মৃত্যুর পরিপূর্ণ সুর। তাই মুক্তি মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক, পূর্ণ করি বুক রিক্ত করি বুক অমন ডাকিতে পারো। আমরা পারি না। বেতস লতার তারে থেকে থেকে বাজে আজ বাতাসের বীণা: ক্রমে তা’ও থেমে যায়; প্রাচীন অরণ্যতীরে চাঁদ নেমে যায়; গাঢ়তর হ’ল অন্ধকার। মুখোমুখি ব’সে আছি সব বেদনার ছায়াচ্ছন্ন গভীর প্রহরে। রাত্রি ঝ’রে পড়ে পাতায় শিশিরে... জীবনের তীরে তীরে... মরণের তীরে তীরে... বেদনা নির্বাক। সে নিবির আচ্ছন্ন তিমিরে বুক চিরে, কোন্ ক্লান্ত কণ্ঠ ঘিরে দূর বনে ওঠে শুধু তৃষাদীর্ণ ডাহুকের ডাক॥
Share:

No comments:

Post a Comment

slidebar

Total Pageviews

Abdullah Mondal

Powered by Blogger.

Blog Archive

Recent Posts

বাস্তবতা

জীবনের বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। এটাই জীবন। জীবনের বাস্তবতার বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যতই নিষ্ঠুর হউক বা যতই কষ্ট হউক তা সয়ে নিতে হয়, মেনে নিতে হয় জীবনের প্রয়োজনেই। জীবনে কষ্ট আসলে মানসিক ভাকে যতটুকু ভেঙ্গে পড়বে জীবন তার দ্বিগুন পিছিয়ে যাবে। জীবনের সকল দূঃখ কষ্ট ও বাস্তবতাকে জীবনের অংশ হিসাবে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করার নামই হচ্ছে সুখ।

Pages