তৈল : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
লেখক পরিচিতি:
https://www.facebook.com/abdullahmandal325.mobi/
পিতার নাম রামকমল ন্যায়রত্ন। জন্মস্থান নৈহাটি, চব্বিশপরগনা।
১৮৫৩ : ৬ ডিসেম্বর তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দ : গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করেন।
১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দ : নানারকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে এন্ট্রান্স পাশ করেন।
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ : এফ.এ পাশ করেন।
১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ : প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। ৮ম স্থান অধিকার করেছিলেন। ‘ভারত মহিলা’ প্রবন্ধ রচনা করে হোলকার পুরস্কার পান। ‘বঙ্গদর্শন’-এ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়।
১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ : সংস্কৃত কলেজ থেকে এম.এ পরীক্ষায় একমাত্র তিনিই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ‘শাস্ত্রী’ উপাধি পান।
১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দ: মার্চ বিবাহ করেন।
কর্মজীবনের সুচনায় কলিকাতা হেয়ার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ক্রমে লক্ষ্ণো ক্যানিং কলেজ, কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।
পুরাতন পুঁথি সংগ্রহের মাধ্যমে চর্যাপদ গবেষণা করে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনত্বকে প্রমাণিত করেন। ‘গোপাল তাপনি’ উপনিষদের ইংরেজী অনুবাদে তিনি রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সহযোগী ছিলেন। ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ গ্রন্থ রচনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত লেখা থেকে পাঠোদ্ধার এবং পুঁথি আবিষ্কার ও টীকা রচনা করে ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখেন। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মৃত্যুর পর এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক সংস্কৃত পুঁথিসংগ্রহের কাজে অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এই কাজে তিনি নেপাল. তিব্বত ভ্রমণ করেন।
১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজে কলেজে এম.এ ক্লাস প্রবর্তন করেন।
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ নেপাল থেকে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম গ্রন্থ-নিদর্শন ‘চর্যাগীতি’ সরোহৃবজ্জ্র রচিত ‘দোহাকোষ’ কাহ্নপাদ রচিত ‘দোহাকোষ’ ও সংস্কৃতে রচিত ‘ডাকার্ণব’- এই চারিটি গ্রন্থ তিনি উদ্ধার করেন। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে তাঁর সম্পাদনায় ‘হাজার বছরের পুরান বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামক সংকলন প্রকাশিত হয়।
বিভিন্ন সময়ে তিনি ভারতের বিভিন্ন সংস্কৃতিবান বিদগ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং লণ্ডন রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির অনারারি সদস্য ছিলেন। তাঁর রচিত ৫২টি নিবন্ধের মধ্যে ঐতিহাসিক নিবন্ধের সংখ্যা বেশী হলেও সময়তত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং শাসনতন্ত্র বিষয়েও কয়েকটি আলোচনা আছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ থেকে তাঁর রচিত সকল গ্রন্থ 'হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ' নামে চারখণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
তৈল যে কি পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন। তাঁহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ। বাস্তবিকও স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি । স্নেহ কি? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে , তাহার নাম স্নেহ । তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর কিসে পারে ?
সংস্কৃত কবিরা ঠিকই বুঝিয়াছিলেন। যেহেতু তাহারা সকল মনুষ্যকেই সমানরূপে স্নেহ করিতে বা তৈল প্রদান করিতে উপদেশ দিয়াছেন।
বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য , যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য,তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্ধারা সিদ্ধ হইতে পারে।
যে সর্বশক্তিময় তৈল ব্যবহার করিতে জানে,সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সকল কাজই সোজা। তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না — উকীলিতে পসার করিবার জন্য সময় নষ্ট করিতে হয় না , বিনা কাজে বসিয়া থাকিতে হয় না, কোন কাজেই শিক্ষানবিশ থাকিতে হয় না।যে তৈল দিতে পারিবে,তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসার হইতে পারে। আহাম্মুক হইলেও ম্যাজিষ্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্ণর হইতে পারে।
তৈলের মহিমা অতি অপরূপ ।তৈল নহিলে জগতের কোন কাজ সিদ্ধ হয় না ।তৈল নহিলে কল চলে না, প্রদীপ জ্বলে না,ব্যঞ্জন সুস্বাদু হয় না, চেহেরা খোলে না , হাজার গুন থাকুক তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না,তৈল থাকিলে তাহার কিছুরই অভাব থাকে না।
সর্বশক্তিময় তৈল নানারূপে সমস্ত পৃথিবী ব্যাপ্ত করিয়া আছেন। তৈলের যে মূর্তিতে আমরা গুরুজনকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম ভক্তি,যাহাতে গৃহিণীকে স্নিগ্ধ করি,তাহার নাম প্রণয়; যাহাতে প্রতিবেশীকে স্নিগ্ধ করি,তাহার নাম মৈত্রী; যাহা দ্ধারা সমস্ত জগৎকে স্নিগ্ধ করি,তাহার নাম শিষ্টাচার ও সৌজন্য “ফিলনথপি।”যাহা দ্ধারা সাহেবকে স্নিগ্ধ করি তাহার নাম লয়েলটি ;যাহা দ্ধারা বড়লোককে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম নম্রতা বা মডেষ্টি ।চাকর বাকর প্রভৃতিকেও আমরা তৈল দিয়া থাকি, তাহার পরিবর্তে ভক্তি বা যত্ন পাই ।অনেকের নিকট তৈল দিয়া তৈল বাহির করি।
পরস্পর ঘর্ষিত হইলে সকল সকল বস্তুতেই অগ্ন্যুদ্গম হয় । অগ্ন্যুদ্গম নিবারণের একমাত্র উপায় তৈল ।এইজন্যই রেলের চাকায় তৈলের অনুকল্প চর্বি দিয়া থাকে ।এইজন্যই যখন দুজনে ঘোরতর বিবাদে লঙ্কাকাণ্ড উপস্থিত হয় ,তখর রফা নামক তৈল আসিয়া উভয় ঠাণ্ডা করিয়া দেয় ।তৈলের যদি অগ্নিনিবারণী শক্তি না থাকিত, তবে গৃহে গৃহে গ্রামে গ্রামে পিতাপুত্রে স্বামী-স্ত্রীতে রাজায়-প্রজায় বিবাগ বিসম্বাদে নিরন্তর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইত ।
পূর্বেই বলা গিয়াছে, যে তৈল দিতে পারে , সে সর্বশক্তিমান ,কিন্তু তৈল দিলেই হয় না। দিবার পাত্র আছে,সময় আছে,কৌশল আছে।
তৈল দ্ধারা অগ্নি পর্যন্ত বশতাপন্ন হয়। অগ্নিতে অল্প তৈল দিয়া সমস্ত রাত্রি ঘরে আবদ্ধ রাখা যায় । কিন্তু সে তৈল মূর্তিমান্ ।
কে যে তৈল দিবার পাত্র নয় ,তাহা বলা যায় না। পুঁটে তেলি হইতে লাটসাহেব পর্যন্ত তৈল দিবার পাত্র । তৈল এমন জিনিষ নয় যে,নষ্ট হয় । একবার দিয়া রাখিলে নিশ্চয়ই কোন না কোন ফল ফলিবে। কিন্তু তথাপি যাহার নিকট উপস্থিত কাজ আদায় করিতে হইবে, সেই তৈলনিষেধের প্রধান পাত্র। সময় — যে সময়েই হউক, তৈল দিয়া রাখিলেই কাজ হইবে । কিন্তু উপযুক্ত সময়ে অল্প তৈলে অধিক কাজ হয় ।
কৌশল — পূর্বেই উল্লেখ করা গিয়েছে, যেরূপেই হউক, তৈল দিলে কিছু না কিছু উপকার হইবে। যেহেতু তৈল নষ্ট হয় না, তথাপি দিবার কৌশল আছে ।তাহার প্রমাণ ভট্টাচার্যেরা সমস্ত দিন বকিয়াও যাহার নিকট পাঁচ সিকা বৈ আদায় করিতে পারিল না ,একজন ইংরেজিওয়ালা তাহার নিকট অনায়াসে ৫০ টাকা বাহির করিয়া লইয়া গেল। কৌশল করিয়া এক বিন্দু দিলে যত কাজ হয়, বিনা কৌশলে কলস কলস ঢালিলেও তত হয় না ।
ব্যক্তিবিশেষে তৈলের গুনতারতাম্য অনেক আছে। নিষ্কৃত্রিম তৈল পাওয়া অতি দুর্লভ। কিন্তু তৈলের এমনি একটি আশ্চর্য সম্মিলনীশক্তি আছে যে, তাহাতে যে উহা অন্য সকল পদার্থের গুনই আত্নসাৎ করিতে পারে। যাহার বিদ্যা আছে,তাহার তৈল আমার তৈল হইতে মূল্যবান। বিদ্যার উপর যাহার বুদ্ধি আছে,তাহার আরও মূল্যবান।তাহার উপর যদি ধন থাকে, তবে তাহার প্রতি বিন্দুর মূল্য লক্ষ টাকা। কিন্তু তৈল না থাকিলে তাহার বুদ্ধি থাকুক,হাজার বিদ্যা থাকুক, হাজার ধন থাকুক, কেহই টের পায় না।
তৈল দিবার প্রবৃত্তি স্বাভাবিক। এ প্রবৃত্তি সকলেরই আছে এবং সুবিধামত আপন গৃহে ও আপন দলে সকলেই ইহা প্রয়োগ করিয়া থাকে, কিন্তু অনেকে এত অধিক স্বার্থপর , বাহিরের লোককে তৈল দিতে পারে না।তৈলদান প্রবৃত্তি স্বাভাবিক হইলেও উহাতে কৃতকার্য হওয়া অদৃষ্টসাপেক্ষ।
আজকাল বিজ্ঞান, শিল্প প্রভৃতি শিখাইবার জন্য নানাবিধ চেষ্টা চলিতেছে।যাহাতে বঙ্গের লোক প্রাকটিক্যাল অর্থাৎ কাজের লোকের হইতে পারে; তজ্জন্য সকলেই সচেষ্ট, কিন্তু কাজের লোক হইতে হইলে তৈলদান সকলের আগে দরকার। অতএব তৈলদানের একটি স্কুলের নিতান্ত প্রয়োজন। অতএব আমরা প্রস্তাব করি, বাছিয়া বাছিয়া কোন রায়বাহাদুর অথবা খাঁ বাহাদুরকে প্রিন্সিপাল করিয়া শীঘ্র একটি স্নেহ-নিষেধের কালেজ খোলা হয় । অন্ততঃ উকীলি শিক্ষার নিমিত্ত ল’ কালেজে একজন তৈল অধ্যাপক নিযুক্ত করা আবশ্যক। কালেজ খুলিতে পারিলে ভালই হয়।
কিন্তু এরূপ কালেজ খুলিতে হইলে প্রথমতই গোলযোগ উপস্থিত হয়। তৈল সবাই দিয়া থাকেন — কিন্তু কেহই স্বীকার করেন না যে, আমি দেই। সুতরাং এ বিদ্যার অধ্যাপক জোটা ভার । এ বিদ্যা শিখিতে হইলে দেখিয়া শুনিয়া শিখিতে হয়। রীতিমত লেকচার পাওয়া যায় না । যদিও কোন রীতিমত কালেজ নাই, তথাপি যাঁহার নিকট চাকরীর বা প্রমোশনের সুপারিস মিলে , তাদৃশ লোকের বাড়ী সদাসর্বদা গেলে উত্তমরূপ শিক্ষালাভ করা যাইতে পারে ।বাঙালীর বল নাই, বিক্রম নাই, বিদ্যাও নাই, বুদ্ধিও নাই। সুতরাং বাঙালীর একমাত্র ভরসা তৈল — বাঙালীর যে কেহ কিছু করিয়াছেন, সকলই তৈলের জোরে, বাঙালীদিগের তৈলের মূল্য অধিক নয়; এবং কি কৌশলে সেই তৈল বিধাতৃপুরুষদিগের সুখসেব্য হয়, তাহাও অতি অল্পলোক জানেন । যাঁহারা জানেন,তাঁহাদিগকে আমরা ধন্যবাদ দিই। তাঁহারাই আমাদের দেশের বড় লোক, তাঁহারাই আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়া আছেন।
তৈল বিধাতৃপুরুষদিগের সুখসেব্য হইবে, ইচ্ছা করিলে সে শিক্ষা এদেশে হওয়া হওয়া কঠিন । তজ্জন্য বিলাত যাওয়া আবশ্যক। তত্রত্য রমণীরা এ বিষয়ের প্রধান অধ্যাপক, তাহাদের থ্রু হইলে তৈল শীঘ্র কাজে আইসে।
শেষে মনে রাখা উচিত ,এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে।
বি.দ্রঃ গোপনে স্বয়ং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়কে তৈল মারিয়া ইহা লেখানো হইয়াছিল এবং সেই মতো আজ আমি এখানে তুলিয়া ধরিলাম আপনাদিগের জন্যে।

লেখক পরিচিতি:
https://www.facebook.com/abdullahmandal325.mobi/
পিতার নাম রামকমল ন্যায়রত্ন। জন্মস্থান নৈহাটি, চব্বিশপরগনা।
১৮৫৩ : ৬ ডিসেম্বর তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দ : গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করেন।
১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দ : নানারকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে এন্ট্রান্স পাশ করেন।
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ : এফ.এ পাশ করেন।
১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ : প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। ৮ম স্থান অধিকার করেছিলেন। ‘ভারত মহিলা’ প্রবন্ধ রচনা করে হোলকার পুরস্কার পান। ‘বঙ্গদর্শন’-এ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়।
১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ : সংস্কৃত কলেজ থেকে এম.এ পরীক্ষায় একমাত্র তিনিই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ‘শাস্ত্রী’ উপাধি পান।
১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দ: মার্চ বিবাহ করেন।
কর্মজীবনের সুচনায় কলিকাতা হেয়ার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ক্রমে লক্ষ্ণো ক্যানিং কলেজ, কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।
পুরাতন পুঁথি সংগ্রহের মাধ্যমে চর্যাপদ গবেষণা করে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনত্বকে প্রমাণিত করেন। ‘গোপাল তাপনি’ উপনিষদের ইংরেজী অনুবাদে তিনি রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সহযোগী ছিলেন। ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ গ্রন্থ রচনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত লেখা থেকে পাঠোদ্ধার এবং পুঁথি আবিষ্কার ও টীকা রচনা করে ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখেন। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মৃত্যুর পর এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক সংস্কৃত পুঁথিসংগ্রহের কাজে অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এই কাজে তিনি নেপাল. তিব্বত ভ্রমণ করেন।
১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজে কলেজে এম.এ ক্লাস প্রবর্তন করেন।
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ নেপাল থেকে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম গ্রন্থ-নিদর্শন ‘চর্যাগীতি’ সরোহৃবজ্জ্র রচিত ‘দোহাকোষ’ কাহ্নপাদ রচিত ‘দোহাকোষ’ ও সংস্কৃতে রচিত ‘ডাকার্ণব’- এই চারিটি গ্রন্থ তিনি উদ্ধার করেন। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে তাঁর সম্পাদনায় ‘হাজার বছরের পুরান বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামক সংকলন প্রকাশিত হয়।
বিভিন্ন সময়ে তিনি ভারতের বিভিন্ন সংস্কৃতিবান বিদগ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং লণ্ডন রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির অনারারি সদস্য ছিলেন। তাঁর রচিত ৫২টি নিবন্ধের মধ্যে ঐতিহাসিক নিবন্ধের সংখ্যা বেশী হলেও সময়তত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং শাসনতন্ত্র বিষয়েও কয়েকটি আলোচনা আছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ থেকে তাঁর রচিত সকল গ্রন্থ 'হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ' নামে চারখণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
তৈল যে কি পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন। তাঁহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ। বাস্তবিকও স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি । স্নেহ কি? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে , তাহার নাম স্নেহ । তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর কিসে পারে ?
সংস্কৃত কবিরা ঠিকই বুঝিয়াছিলেন। যেহেতু তাহারা সকল মনুষ্যকেই সমানরূপে স্নেহ করিতে বা তৈল প্রদান করিতে উপদেশ দিয়াছেন।
বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য , যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য,তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্ধারা সিদ্ধ হইতে পারে।
যে সর্বশক্তিময় তৈল ব্যবহার করিতে জানে,সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সকল কাজই সোজা। তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না — উকীলিতে পসার করিবার জন্য সময় নষ্ট করিতে হয় না , বিনা কাজে বসিয়া থাকিতে হয় না, কোন কাজেই শিক্ষানবিশ থাকিতে হয় না।যে তৈল দিতে পারিবে,তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসার হইতে পারে। আহাম্মুক হইলেও ম্যাজিষ্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্ণর হইতে পারে।
তৈলের মহিমা অতি অপরূপ ।তৈল নহিলে জগতের কোন কাজ সিদ্ধ হয় না ।তৈল নহিলে কল চলে না, প্রদীপ জ্বলে না,ব্যঞ্জন সুস্বাদু হয় না, চেহেরা খোলে না , হাজার গুন থাকুক তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না,তৈল থাকিলে তাহার কিছুরই অভাব থাকে না।
সর্বশক্তিময় তৈল নানারূপে সমস্ত পৃথিবী ব্যাপ্ত করিয়া আছেন। তৈলের যে মূর্তিতে আমরা গুরুজনকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম ভক্তি,যাহাতে গৃহিণীকে স্নিগ্ধ করি,তাহার নাম প্রণয়; যাহাতে প্রতিবেশীকে স্নিগ্ধ করি,তাহার নাম মৈত্রী; যাহা দ্ধারা সমস্ত জগৎকে স্নিগ্ধ করি,তাহার নাম শিষ্টাচার ও সৌজন্য “ফিলনথপি।”যাহা দ্ধারা সাহেবকে স্নিগ্ধ করি তাহার নাম লয়েলটি ;যাহা দ্ধারা বড়লোককে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম নম্রতা বা মডেষ্টি ।চাকর বাকর প্রভৃতিকেও আমরা তৈল দিয়া থাকি, তাহার পরিবর্তে ভক্তি বা যত্ন পাই ।অনেকের নিকট তৈল দিয়া তৈল বাহির করি।
পরস্পর ঘর্ষিত হইলে সকল সকল বস্তুতেই অগ্ন্যুদ্গম হয় । অগ্ন্যুদ্গম নিবারণের একমাত্র উপায় তৈল ।এইজন্যই রেলের চাকায় তৈলের অনুকল্প চর্বি দিয়া থাকে ।এইজন্যই যখন দুজনে ঘোরতর বিবাদে লঙ্কাকাণ্ড উপস্থিত হয় ,তখর রফা নামক তৈল আসিয়া উভয় ঠাণ্ডা করিয়া দেয় ।তৈলের যদি অগ্নিনিবারণী শক্তি না থাকিত, তবে গৃহে গৃহে গ্রামে গ্রামে পিতাপুত্রে স্বামী-স্ত্রীতে রাজায়-প্রজায় বিবাগ বিসম্বাদে নিরন্তর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইত ।
পূর্বেই বলা গিয়াছে, যে তৈল দিতে পারে , সে সর্বশক্তিমান ,কিন্তু তৈল দিলেই হয় না। দিবার পাত্র আছে,সময় আছে,কৌশল আছে।
তৈল দ্ধারা অগ্নি পর্যন্ত বশতাপন্ন হয়। অগ্নিতে অল্প তৈল দিয়া সমস্ত রাত্রি ঘরে আবদ্ধ রাখা যায় । কিন্তু সে তৈল মূর্তিমান্ ।
কে যে তৈল দিবার পাত্র নয় ,তাহা বলা যায় না। পুঁটে তেলি হইতে লাটসাহেব পর্যন্ত তৈল দিবার পাত্র । তৈল এমন জিনিষ নয় যে,নষ্ট হয় । একবার দিয়া রাখিলে নিশ্চয়ই কোন না কোন ফল ফলিবে। কিন্তু তথাপি যাহার নিকট উপস্থিত কাজ আদায় করিতে হইবে, সেই তৈলনিষেধের প্রধান পাত্র। সময় — যে সময়েই হউক, তৈল দিয়া রাখিলেই কাজ হইবে । কিন্তু উপযুক্ত সময়ে অল্প তৈলে অধিক কাজ হয় ।
কৌশল — পূর্বেই উল্লেখ করা গিয়েছে, যেরূপেই হউক, তৈল দিলে কিছু না কিছু উপকার হইবে। যেহেতু তৈল নষ্ট হয় না, তথাপি দিবার কৌশল আছে ।তাহার প্রমাণ ভট্টাচার্যেরা সমস্ত দিন বকিয়াও যাহার নিকট পাঁচ সিকা বৈ আদায় করিতে পারিল না ,একজন ইংরেজিওয়ালা তাহার নিকট অনায়াসে ৫০ টাকা বাহির করিয়া লইয়া গেল। কৌশল করিয়া এক বিন্দু দিলে যত কাজ হয়, বিনা কৌশলে কলস কলস ঢালিলেও তত হয় না ।
ব্যক্তিবিশেষে তৈলের গুনতারতাম্য অনেক আছে। নিষ্কৃত্রিম তৈল পাওয়া অতি দুর্লভ। কিন্তু তৈলের এমনি একটি আশ্চর্য সম্মিলনীশক্তি আছে যে, তাহাতে যে উহা অন্য সকল পদার্থের গুনই আত্নসাৎ করিতে পারে। যাহার বিদ্যা আছে,তাহার তৈল আমার তৈল হইতে মূল্যবান। বিদ্যার উপর যাহার বুদ্ধি আছে,তাহার আরও মূল্যবান।তাহার উপর যদি ধন থাকে, তবে তাহার প্রতি বিন্দুর মূল্য লক্ষ টাকা। কিন্তু তৈল না থাকিলে তাহার বুদ্ধি থাকুক,হাজার বিদ্যা থাকুক, হাজার ধন থাকুক, কেহই টের পায় না।
তৈল দিবার প্রবৃত্তি স্বাভাবিক। এ প্রবৃত্তি সকলেরই আছে এবং সুবিধামত আপন গৃহে ও আপন দলে সকলেই ইহা প্রয়োগ করিয়া থাকে, কিন্তু অনেকে এত অধিক স্বার্থপর , বাহিরের লোককে তৈল দিতে পারে না।তৈলদান প্রবৃত্তি স্বাভাবিক হইলেও উহাতে কৃতকার্য হওয়া অদৃষ্টসাপেক্ষ।
আজকাল বিজ্ঞান, শিল্প প্রভৃতি শিখাইবার জন্য নানাবিধ চেষ্টা চলিতেছে।যাহাতে বঙ্গের লোক প্রাকটিক্যাল অর্থাৎ কাজের লোকের হইতে পারে; তজ্জন্য সকলেই সচেষ্ট, কিন্তু কাজের লোক হইতে হইলে তৈলদান সকলের আগে দরকার। অতএব তৈলদানের একটি স্কুলের নিতান্ত প্রয়োজন। অতএব আমরা প্রস্তাব করি, বাছিয়া বাছিয়া কোন রায়বাহাদুর অথবা খাঁ বাহাদুরকে প্রিন্সিপাল করিয়া শীঘ্র একটি স্নেহ-নিষেধের কালেজ খোলা হয় । অন্ততঃ উকীলি শিক্ষার নিমিত্ত ল’ কালেজে একজন তৈল অধ্যাপক নিযুক্ত করা আবশ্যক। কালেজ খুলিতে পারিলে ভালই হয়।
কিন্তু এরূপ কালেজ খুলিতে হইলে প্রথমতই গোলযোগ উপস্থিত হয়। তৈল সবাই দিয়া থাকেন — কিন্তু কেহই স্বীকার করেন না যে, আমি দেই। সুতরাং এ বিদ্যার অধ্যাপক জোটা ভার । এ বিদ্যা শিখিতে হইলে দেখিয়া শুনিয়া শিখিতে হয়। রীতিমত লেকচার পাওয়া যায় না । যদিও কোন রীতিমত কালেজ নাই, তথাপি যাঁহার নিকট চাকরীর বা প্রমোশনের সুপারিস মিলে , তাদৃশ লোকের বাড়ী সদাসর্বদা গেলে উত্তমরূপ শিক্ষালাভ করা যাইতে পারে ।বাঙালীর বল নাই, বিক্রম নাই, বিদ্যাও নাই, বুদ্ধিও নাই। সুতরাং বাঙালীর একমাত্র ভরসা তৈল — বাঙালীর যে কেহ কিছু করিয়াছেন, সকলই তৈলের জোরে, বাঙালীদিগের তৈলের মূল্য অধিক নয়; এবং কি কৌশলে সেই তৈল বিধাতৃপুরুষদিগের সুখসেব্য হয়, তাহাও অতি অল্পলোক জানেন । যাঁহারা জানেন,তাঁহাদিগকে আমরা ধন্যবাদ দিই। তাঁহারাই আমাদের দেশের বড় লোক, তাঁহারাই আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়া আছেন।
তৈল বিধাতৃপুরুষদিগের সুখসেব্য হইবে, ইচ্ছা করিলে সে শিক্ষা এদেশে হওয়া হওয়া কঠিন । তজ্জন্য বিলাত যাওয়া আবশ্যক। তত্রত্য রমণীরা এ বিষয়ের প্রধান অধ্যাপক, তাহাদের থ্রু হইলে তৈল শীঘ্র কাজে আইসে।
শেষে মনে রাখা উচিত ,এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে।
বি.দ্রঃ গোপনে স্বয়ং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়কে তৈল মারিয়া ইহা লেখানো হইয়াছিল এবং সেই মতো আজ আমি এখানে তুলিয়া ধরিলাম আপনাদিগের জন্যে।









No comments:
Post a Comment