চৈতী হাওয়া

চৈতী হাওয়া কাজী নজরুল ইসলাম https://www.facebook.com/abdullahmandal325.mobi/ হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-পাইনি খুঁজে আর, আজ্কে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার! আজ্কে তোমার জন্মদিন- স্মরণ-বেলায় নিদ্রাহীন হাত্ড়ে ফিরি হারিয়ে-যাওয়ার অকূল অন্ধকার! এই -সে হেথাই হারিয়ে গেছে কুড়িয়ে-পাওয়া হার! শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল, কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল? আঁধার দীঘির রাঙলে মুখ, নিটোল ঢেউ-এর ভাঙলে বুক,- কোন্ পূজারী নিল ছিঁড়ে? ছিন্ন তোমার দল ঢেকেছে আজ কোন্ দেবতার কোন্ সে পাষাণ-তল? অস্ত-খেয়ার হারামাণিক-বোঝাই-করা না’ আস্ছে নিতুই ফিরিয়ে দেওয়ার উদয়-পারের গাঁ ঘাটে আমি রই ব’সে আমার মাণিক কই গো সে? পারাবারের ঢেউ-দোলানী হান্ছে বুকে ঘা! আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল-পা! বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুম্রে ওঠে মন, পেয়েছিলাম এম্নি হাওয়ায় তোমার পরশন। তেম্নি আবার মহুয়া-মউ মৌমাছিদের কৃষ্ণ-বউ পান ক’রে ওই ঢুল্ছে নেশায়, দুল্ছে মহুল বন, ফুল-সৌখিন্ দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন! প’ড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি যুঁই, মধুপ দেখে যাদের শাখা আপ্নি যেত নুই। হাস্তে তুমি দুলিয়ে ডাল, গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল থর্কমলী আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই! বকুল শাখা-ব্যকুল হ’ত টলমলাত ভুঁই! চৈতী রাতের গাইত’ গজল বুলবুলিয়ার রব, দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর! ভুঁই- তারকা সুন্দরী সজনে ফুলের দল ঝরি’ থোপা থোপা লা ছড়াত দোলন-খোঁপার’ পর। ঝাজাল হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙার স্বর! পিয়ালবনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ! খেত বঁধুর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ! লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই, বলতে, ‘আমি অমনি চাই! খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ! হিজল শাখায় ডাকত পাখি “ বউ গো কথা কউ” ডাকত ডাহুক জল- পায়রা নাচত ভরা বিল, জোড়া ভুর” ওড়া যেন আসমানে গাঙচিল হঠাৎ জলে রাখত্ে পা, কাজলা দীঘির শিউরে গা- কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল-ঝিল! ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর দীঘির নীল! উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকেল যায়, ঘুম জড়ানো ঘুমতী নদীর ঘুমুর পরা পায়! শঙ্খ বাজে মন্দিরে, সন্ধ্যা আসে বন ঘিরে, ঝাউ-এর শাখায় ভেজা আঁধার কে পিঁজেছে হায়! মাঠের বাঁশী বন্-উদাসী ভীম্পলাশী গায়অ বাউল আজি বাউল হ’ল আমরা তফাতে! আম-মুকুলের গুঁজি-কাঠি দাও কি খোঁপাতে? ডাবের শীতল জল দিয়ে মুখ মাজ’কি আর প্রিয়ে? প্রজাপতির ডাক-ঝরা সোনার টোপাতে ভাঙা ভুর” দাও কি জোড়া রাতুল শোভাতে? বউল ঝ’রে ফ’লেছ আজ থোলো থোলো আম, রসের পীড়ায় টস্টসে বুক ঝুরছে গোপাবজাম! কামরাঙারা রাঙল ফের পীড়ন পেতে ঐ মুখের, স্মরণ ক’রে চিবুক তোমার, বুকের তোমার ঠাম- জামর”লে রস ফেটে পড়ে, হায়, কে দেবে দাম! ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর, ভেবেছিলুম গাঁথ্ব মালা পাইনে খুঁজে ডোর! সেই চাহনি নীল-কমল ভ’রল আমার মানস-জল, কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্মমূলে মোর! বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর! তরী আমার কোন্ কিনারায় পাইনে খুঁজে কুল, স্মরণ-পারের গন্ধ পাঠায় কমলা নেবুর ফুল! পাহাড়তলীর শালবনায় বিষের মত নীল ঘনায়! সাঁঝ প’রেছে ঐ দ্বিতীয়ার-চাঁদ-ইহুদী-দুল! হায় গো, আমার ভিন্ গাঁয়ে আজ পথ হ’য়েছে ভুল! কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই, কেঁদে ফিরে যায় যে চৈত-তোমার দেখা নেই! কন্ঠে কাঁদে একটি স্বর- কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর? তেমনি ক’রে জাগছে কি রাত আমার আশাতেই? কুড়িয়ে পাওয়া বেলায় খুঁজি হারিয়ে যাওয়া খেই! পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’, এই তরীতে হয়ত তোমার প’ড়বে রাঙা পা! আবার তোমার সুখ-ছোঁওয়ায় আকুল দোলা লাগবে না’য়, এক তরীতে যাব মোরা আর-না-হারা গাঁ পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’।। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত জীবনী ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানায় অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিনউল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়া পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। তারা ছিলেন তিন ভাই এবং বোন। তার সহোদর তিন ভাই ও দুই বোনের নাম হল: সবার বড় কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। তিনি স্থানীয় মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম , দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে যখন তার বাবা মারা যান তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেননা। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল) দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফারসি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ সালের শেষভাগ থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯২২ সালে বিজলী কবিতায় প্রকাশিত হওয়ামাত্রই জাগরণ সৃষ্টি করে।দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালী মানসিকতায় কবিতাটি "চির উন্নত শির" বিরাজমান। বল বীর - বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি, নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির! বল বীর - বল মহা বিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’ ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া, খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর! মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর! বল বীর- আমি চির উন্নত শির যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্। প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল। তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েস। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টরুপে জানা যায় ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে।১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ সালে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়।এরপর ১৯৫৩ সালের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। মে ১০ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন। লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। অবশেষে ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কবি তার একটি কবিতায় বলেছিলেন: “মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই” এই কবিতায় তার অন্তিম ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। তার এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়। কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে (বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায়) ২০০৫ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় নামক সরকারী সরকারী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কবির জন্মস্থান চুরুলিয়ায় নজরুল অ্যাকাডেমি ও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কবির স্মৃতিতে নজরুল একাডেমী, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ও বাংলাদেশ নজরুল সেনা স্থাপিত হয়। কলকাতায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও মূল শহরের সংযোগকারী প্রধান রাস্তাটি কবির নামে উৎসর্গ করে কাজী নজরুল ইসলাম সরণি করা হয়। এছাড়াও কলকাতা মেট্রোর গড়িয়া বাজার স্টেশনটিকে কবির সম্মানে কবি নজরুল নামে উৎসর্গিত করা হয়েছে। Image may contain: 1 person, hat and eyeglasses
Share:

No comments:

Post a Comment

slidebar

Total Pageviews

Abdullah Mondal

Powered by Blogger.

Blog Archive

Recent Posts

বাস্তবতা

জীবনের বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। এটাই জীবন। জীবনের বাস্তবতার বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যতই নিষ্ঠুর হউক বা যতই কষ্ট হউক তা সয়ে নিতে হয়, মেনে নিতে হয় জীবনের প্রয়োজনেই। জীবনে কষ্ট আসলে মানসিক ভাকে যতটুকু ভেঙ্গে পড়বে জীবন তার দ্বিগুন পিছিয়ে যাবে। জীবনের সকল দূঃখ কষ্ট ও বাস্তবতাকে জীবনের অংশ হিসাবে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করার নামই হচ্ছে সুখ।

Pages