দুপচাঁচিয়া উপজেলা।
দুপচাঁচিয়া (ইংরেজি: Dupchanchia) বাংলাদেশের বগুড়া জেলার একটি
প্রশাসনিক এলাকা; যেটি পূর্বে "ধুপচাঁচিয়া"
নামে পরিচিত ছিল। এটি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বগুড়া-৩ আসনের অন্তর্গত।
বগুড়া সদর থেকে দুপচাঁচিয়া উপজেলা
সদরের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। এর মোট আয়তন ১৬২.৪৫ বর্গ কিলোমিটার এবং
দুপচাঁচিয়া পৌরসভার আয়তন প্রায় ১০.৯৩ বর্গ কিলোমিটার। এর পূর্ব পাশ দিয়ে নাগর
নদী বয়ে গেছে। দুপচাঁচিয়া বগুড়া জেলার অন্যতম বড় একটি উপজেলা। দুপচাঁচিয়া এর
উত্তরে- জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলা, দক্ষিণে- বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা ও কাহালু উপজেলা, পুর্বে-জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর
উপজেলা এবং বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলা, পশ্চিমে-জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলা ও বগুড়া জেলার আদমদীঘি
উপজেলা।
দুপচাঁচিয়া পৌরসভা ২০০০ সালে
প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যা নয়টি ওয়ার্ড ও আটত্রিশটি মহল্লার সমন্বয়ে গঠিত।
দুপচাঁচিয়া পৌরসভা ছাড়াও তালোড়া পৌরসভা নামে আরও আরও একটি পৌরসভা ২০১২ সালে
গঠিত হয়। এছারাও এই উপজেলার অন্তর্গত ৬ টি ইউনিয়ন, ১১৫ টি মৌজা এবং ২৩০ টি গ্রাম আছে। পোস্ট অফিস আছে ১১ টি।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী
দুপচাঁচিয়া উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৪,৪৬,২৬৩ জন।[১] যার ১,৬০,৮৯৪ জন পুরুষ ও ১৭৯,২৯০
জন নারী। প্রতি কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ৯৯০ জন। দুপচাঁচিয়া উপজেলার মোট ভোটার
সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজার ৬৮৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬১ হাজার ৮১৯ জন ও মহিলা
ভোটার ৬৩ হাজার ৮৭০ জন।
"দুপচাঁচিয়া" নামটির উৎপত্তি
সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন ধারণা পাওয়া যায় না। জনশ্রুতি আছে যে এখানে নাকি
একসময় প্রচুর "ধুপ" উৎপন্ন হত। অনেকে বলেন সেই "ধুপ" হতেই
"ধুপচাঁচিয়া" নামের সৃষ্টি। আবার অনেকে বলেন এককালে হিন্দু প্রধান
এলাকা হিসাবে এখানে প্রচুর ধোপা শ্রেণির লোক বাস করত। এই ধোপা কথাটি থেকেই
কালক্রমে এই এলাকার নামকরণ হয়েছে ধোপচাঁচিয়া। এছাড়াও প্রচলিত আছে এখানে একসময়
"ধূপছায়া" নামে একধরনের শাড়ি পাওয়া যেত। যা দেশে বিদেশে অনেক বিখ্যাত
ছিল। সেই ধূপছায়া হতে "ধুপচাঁচিয়া" নামের উৎপত্তি, যা পরবর্তীতে
"দুপচাঁচিয়াতে" পরিবর্তিত হয়েছে।[২]
দুপচাঁচিয়া পুলিশ থানার কার্যক্রম
১৮৮০ সালে শুরু হয়। দুপচাঁচিয়া থানাটি ১৯৮৩ সালের ১২ ডিসেম্বর বগুড়া জেলার
মধ্যে প্রথম পর্যায়ে উপজেলায় উন্নীত হয়। পরবর্তীতে ২০০০ সালের ২০ এপ্রিল
স্থানীয় সরকার মন্ত্রলায়ের আদেশ বলে দুপচাঁচিয়া পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়।
দুপচাঁচিয়া উপজেলাতে সরঃ প্রাথমিক
বিদ্যালয় আছে ৮৪ টি[৩], মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ২৬ টি, মাদ্রাসা আছে ২৬ টি, কলেজ আছে ৮ টি[৪]। দুপচাঁচিয়াতে
বর্তমানে শিক্ষার হার ৫৬.৫%।
দুপচাঁচিয়া উপজেলাতে মোট জমির পরিমাণ
২৪,০৫৪ হেক্টর। এতে মোট ফসলী জমির পরিমাণ
৫৫,৬৯০ হেক্টর। অধিকাংশই দুই ফসলী জমি বা
তিন ফসলী জমি। জমিতে সেচ দেয়ার জন্য গভীর নলকূপ আছে ৫৬৭ টি এবং অ-গভীর নলকূপ আছে
৬৯৯ টি। এ উপজেলাতে বাৎসরিক মোট ১,৩২,০০০মে: টন খাদ্য উৎপাদিত হয় যেখানে
বাৎসরিক খাদ্য চাহিদা ৩৭,৯৯০মেঃ টন। উদ্ধৃত খাদ্য রাজধানী
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।
২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এ
উপজেলার জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস কৃষি ৬৬.৪৪%, ব্যবসা ১৩.৮৪%,
চাকরি ৪.৪৩%, পরিবহণ ও যোগাযোগ ৩.৯৭%, অকৃষি শ্রমিক ২.৭৭%, শিল্প ০.৭৪%, নির্মাণ ০.৬৫%, ধর্মীয় সেবা ০.১২%, রেন্ট অ্যান্ড রেমিটেন্স ০.৬৫% এবং
অন্যান্য ৬.৩৯%। এখানকার প্রধান রপ্তানিদ্রব্য ধান, চাল, বিস্কুট, মাছ ও দুধ। [৫] অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পণ্যঃ
কৃষিপণ্যঃ দুপচাঁচিয়া উপজেলার
কৃষিপণ্যকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। খাদ্যশস্য জাতীয়- ধান, গম, আলু, সরিষা। শাক সবজি- লাউ, শিম, লাউ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাল শাক, পালং শাক, ঢেঁড়স, ডাটা শাক, সজিনা, বরবটি, কচু। মসলা- পিঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ।
খোলাশ খেলনা শিল্পঃ উপজেলার আড়াই কিঃ
মিঃ উত্তরে ঐতিহাসিক ধাপসুলতানগঞ্জ হাটের পরেই খোলাশ গ্রাম। এ গ্রামের মোন্না
পাড়ায় বহু পরিবার খেলনা শিল্পের সাথে জড়িত। শুরুতে এখানে টমটম, ঘিরনি সহ ৭/৮ ধরনের খেলনা তৈরি হত।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্লাস্টিক খেলনা তৈরিতে জড়িয়ে পড়েছে এসব শিল্পীরা।
দেশের বিভিন্ন স্থানে এ এলাকার খেলনার কদর রয়েছে।
এলুমিনিয়াম ফ্যাক্টরিঃ তালোড়ায় ১৯৫৪
সালে উত্তর বঙ্গের প্রথম এলুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয়। লাদুরাম আগারওয়ালা
নামে এক মারোয়ারী খেতওয়াত এলুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি চালু করেন। পরবর্তীতে আরও বেশ
কয়েকটি এলুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি এখানে গড়ে উঠে। এসব ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত মালামাল
উত্তরবঙ্গ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সমাদৃত।
মিল-চাতালঃ উত্তরবঙ্গের মধ্যে
দুপচাঁচিয়া উপজেলার চাল প্রসিদ্ধ। এ উপজেলার চাল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন
মোকামে সুনামের সাথে বিক্রি হয়। এ উপজেলায় ৫ শতাধিক চাতাল ও চাউলকল স্থাপিত রয়েছে।
উপজেলা সদর, তালোড়া, চৌমুহনী ও সাহারপুকুরে এ ধরনের মিল চাতাল বেশী।
তাঁত শিল্পঃ দুপচাঁচিয়া উপজেলার তাঁত
শিল্পের ইতিহাস বহু পুরাতন। দুপচাঁচিয়া থানা সৃষ্টির অনেক আগে তাঁত শিল্প গড়ে
উঠেছিল। তাঁত শিল্পের তৈরি ধূপছায়া নামক শাড়ি এ অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল। কালক্রমে
ধূপছায়া শাড়ীর নাম থেকেই দুপচাঁচিয়া নামকরণ করা হয়েছে বলে কথিত আছে। পরে তাঁত
শিল্পের বিলুপ্তি ঘটে। এ তাঁত সূত্র ধরেই উপজেলার দেবখন্ড তাঁতিপাড়া, নলঘড়িয়া, ডাকাহার গ্রাম, তারাজুন গ্রাম, চান্দাইল গ্রাম, নূরপুর গ্রাম, নওদাপাড়া, ফুটানিগঞ্জ গ্রামের প্রায় ৩ শত পরিবার
এ তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। এসব তাঁত শিল্পের উৎপাদিত
পণ্যের মধ্যে গায়ের চাদর,
গামছা, লুঙ্গি, বিছানার চাদর উল্লেখযোগ্য।
মৎস্য চাষঃ দুপচাঁচিয়া উপজেলায়
প্রায় ৩,৫০০ টি পুকুর ও ৪৪৬ টি জলাশয় রয়েছে।
উপজেলার খাস পুকুরগুলো সরকারীভাবে লিজ দিয়ে মাছ চাষ করা হয়। এছাড়াও ব্যক্তিগত
পর্যায়ে পুকুরগুলোকে ব্যবসায়ের কেন্দ্র হিসেবে ব্যাপকভাবে মাছ চাষ করা হয়।
উপজেলার অধিকাংশ পুকুর ও জলাশয়ে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প,
পাংগাস মাছ
ব্যাপকহারে চাষ করা হয়ে থাকে। ব্যাপকভাবে মাছ চাষ বিস্তার লাভ করায় মাছের পোনার
চাহিদা পূরণের জন্য অনেক মৎস্য বীজাগার অত্র এলাকায় গড়ে উঠেছে।
গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগী পালনঃ ২০০৬
সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী উপজেলা পশু পালন অফিস সূত্রে জানা যায় গরুর সংখ্যা
২৭১৫০ টি, মহিষের সংখ্যা ৩১২০ টি, ছাগলের সংখ্যা ২৪,৭৮৬ টি, ভেড়ার সংখ্যা ৫২৪২ টি, মোরগ-মুরগীর সংখ্যা ৪৫,৬৮২ টি, হাঁসের সংখ্যা ৪৮৩০২ টি। উপজেলায় ২৬
টি ডেইরী ফার্ম ও ২৯ টি মুরগীর ফার্ম গড়ে উঠেছে।
দুপচাঁচিয়া উপজেলাতে সরকারী ও
বেসরকারী মিলেয়ে ব্যাংকের সংখ্যা ১১টি।
দুপচাঁচিয়াতে সরকারী হাসপাতাল ও
কমিউনিটি ক্লিনিক এর পাশাপাশি বেশ কিছু ক্লিনিক বেসরকারীভাবে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে
দুপচাঁচিয়া উপজেলাতে ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে ০১টি, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কেন্দ্র আছে
০৪টি, কমিউনিটি ক্লিনিক আছে ২৪টি এবং
বেসরকারী ক্লিনিক আছে ০৮ টি। বগুড়া জেলার সবচেয়ে বড় হাট "ধাপের হাট"
এই দুপচাঁচিয়াতেই অবস্থিত। এছারাও আরও ছোট-বড় ২১ টি হাট-বাজার আছে।[১]












